শাহিদুল হক একজন কবি, একজন ছড়াকার, গাল্পিক ও গবেষক। তবে তার ছড়া শুধু ছড়া নয়,
ভেঙে ভেঙে গড়া, ধেয়ে ধেয়ে নড়া বাংলা ভাষার গাঁথুনির বিশক্ত এক ভিত। যার তুলনা শুধু শাহিদুলের ছড়া, আর কিছু নয়। মূলত ব্যাকরণ ও ভাষার শুদ্ধতা নিয়ে তিনি ছড়া লেখেন। আমার জানামতে, বাংলা ভাষায় এখন তার মতো এমন বিশেষায়িত ও বিশেষ বিষয়ে নিবেদিত ছড়কার আর নেই। বাংলা প্রত্যেকটি বর্ণ নিয়ে সবচেয়ে ছোট বাক্যটির রচয়িতা শাহিদুল হক।৩৯ শব্দের একটি বাক্যে তিনি সবগুলো স্বরবর্ণ ও ব্যাঞ্জনবর্ণের সঙ্গে -কার চিহ্নসহ অনুস্বর, বিসর্গ ও চন্দ্রবিন্দু প্রয়োগ করে নিচের বাক্যটি লিখেছেন :
“উনিশে কার্তিক রাত্র সাড়ে আট ঘটিকায় ভৈরবনিবাসী ব্যাংকের ক্ষুদ্র-ঋণগ্রস্থ অভাবী দুঃস্থ প্রোঢ় কৃষক এজাজ মিঞা হাতের কাছে ঔষধ থাকিতেওঐ ঋণের ডরেই চোখে ঝাপসা দেখিয়া বুকের যন্ত্রণায় ঈষৎ কাঁপিয়া উঠিয়া উঠানে বিছানো ধূসর রঙের ফরাশের উপর ঢলিয়া পড়িলেন।”
এ বাক্যে কোনো কোনো বর্ণ বা চিহ্ন একাধিক বার ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু বাংলা বর্ণমালার সবগুলো বর্ণ ও চিহ্ন কেবল একবার ব্যবহার করে তিনি সহজ ও সরল ভাষায় একটা ছড়া লিখেছেন :
“ঘূর্ণিঝড়ে ঊষা বক্ষেে
ঈগল অনুঃ ছায়া ঐ
প্রোঢ় ঋভু মঞ্চে উঠে
ঔদার্য খোঁজে ওই
ডিঙা ঢৎ তফাৎ আশা
এ ধারাটা থেকে হাসা।”
বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন অঙ্গনে-প্রাঙ্গনে তার রয়েছে সবল ও সাবালীল পদচারণা। তবে আমার কাছে তিনি বাংলা ব্যকরণবিদ ও দুরন্ত-কুশলী জ্ঞানমাল্যমণ্ডিত অনবদ্য এক
ছড়কার। তার ছড়া পড়ে মনে হয় : শব্দ ও অক্ষরগুলো যেন তার একান্ত অনুগত হওয়ার যেন সৃষ্টি হয়েছে। তার কলমের ডগা হতে বের হয়ে শব্দরা যেখানে বসলে সবচেয়ে সুন্দর হয়, ঠিক সেখানে গিয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বসে যায়। এটি এক যাদুকরী খেলা। শব্দের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এমন যাদুকরিত্ব খুব কমই দেখা যায়। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত যদি ছন্দের যাদুকর হয়, তো আমাদের শাহিদুল- ছন্দের মাধুর্য এবং সুরের মুর্ছনায় অবাধ্য শব্দের নিপুণ কারিগর :
“‘মুখরিত’ ‘মুখর’ হবে
সবিনয়ে বলছি
চর্চা ছাড়া খুলবে না জট
ভুলে-ভালেই চলছি।” (গোপনীয় কথা, বানান নিয়ে বানানো কথা)
সাধারণত একজন ছড়াকার অসংখ্য বিষয়ে ছড়া লিখেন, মনে যা আসেন তা-ই ছড়ার বিষয়বস্তু হয়ে যায়। বিষয়স্তুর বৈচিত্র্যের কারণে বিশাল শব্দভাণ্ডার থাকায় তাদেরকে ছড়ায় শব্দ-প্রয়োগ নিয়ে তেমন বেগ পেতে হয় না। কিন্তু শাহিদুলের ছড়ার বিষয়বস্তু নির্দিষ্ট এবং বাংলা ব্যাকরণভিত্তিক, তাই এটি বেশ জটিল এবংসীমিত শব্দ নিয়ে ছড়া কাটতে হয়। এ জটিল কিন্তু মারাত্মক শব্দ-সৈমীত্যের মধ্যেও শাহিদুল যেভাবে বৃষ্টির বাণীর মতো ছাড়া কেটে যান, তা বিস্ময়করই বটে:
“‘শব্দ’ শেষে ‘ইক’ প্রত্যয়ে
‘অঙ্গ’ হলে ‘আঙ্গিক’
তেমনতর মজার খেলা
‘শব্দ’ হবে ‘শাব্দিক’।” (-ইক হলেই হ্রস্ব ই-কার, বানান নিয়ে বানানো কথা)
অনেকে বলে থাকেন, ছড়া অর্থহীন হলেও ক্ষতি নেই। বলা হয়, এটি শুধু আনন্দ-দানের জন্য রচিত। আগডুম-বাগডুম একটা লিখলেই হয়ে গেল। তবে শাহিদুলের ছড়া, অর্থহীন নয়, অর্থপুষ্ট; শিক্ষণীয়, আনন্দঘন ও রসাত্মক। তার প্রতিটি ছড়া যেন এক একটি প্রবন্ধ। আমরা গবেষণাধর্মী যেসব বিষয়-ভাবনা ও চিন্তাচেতনা সাধারণত গদ্যাকারে, প্রবন্ধ নামে ব্যক্ত করি, শাহিদুল সেসব বিষয়কে সহজে অনাবিল ভাষায় নির্ঝর অনুধ্যানে ছড়াকারে ছড়িয়ে দেয়।
“বধূ কেন বউ হলো যে
ভাবছি যখন রাতে
সুতো পেলাম সূত্র থেকে।
হঠাৎ তখন হাতে। (বধূ কেন বউ হলে, বানান নিয়ে বানানো কথা)
ছড়া সম্পর্কে আর একটি কথা বলা হয়, ছড়া নাকি শুধু শিশুদের জন্য। শাহিদুলের ছড়া এ প্রতীতিকে স্বীকার করে না। তার ছড়া শিশু হতে বৃদ্ধ এবং সাধারণ শিক্ষিত হতে গবেষক পর্যন্ত সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতার অনবদ্যতায় নান্দনিকভাবে যোজিত একটি অভূতপূর্ব শিল্পকর্ম। এখান থেকে শিশুরা যেমন নিতে পারে রস, গন্ধ, রঙ আর জ্ঞান তেমনি নিতে পারেন বড়রাও। এ বিবেচনায়, শাহিদুল বাংলাদেশের একজন ব্যতিক্রমী ছড়াকার। ছড়ায় ছড়ায় ছন্দের মালা গেঁথে তিনি কঠিন জটিল ব্যাকরণের দুর্বোধ্য সুত্রগুলো সবুজ ঘাস হতে শিশিরের আনন্দ নেওয়ার মতো বিমূর্ততায় উপস্থাপন করতে পারেন
:
“অদ্ভুত ঐ ভূতের ছানা
ভূতটাকে আজ ধরব
অঙ্গিভূত আবির্ভূত
বশীভূত করব।” (অদ্ভুত ঐ ভূতের ছানা, বানান নিয়ে বানানো কথা)
ব্যাকরণকে বলা হয় গবেষণা, নিরস বিষয়, অনেকের মতো এটি নাকি সাহিত্যকর্মও নয়। কিন্তু শাহিদুলের ব্যাকরণে রং, রস, উদ্দীপনা, সম্পর্ক, টানাপোড়েন, রম্যতা প্রভৃতি বিষয় লাইনে
লাইনে লুকিয়ে। ব্যাকরণানগত ছড়ার মধ্যে তিনি অপূর্ব কৌশলে ভরে রাখতে পারেন সামাজিক বৈষম্য, মানসিক হীনম্মন্যতা, রাষ্ট্রীয় আচার আর বৈশ্বিক বিষয়। তাই তার ছড়া শুধু শিশুদের আনন্দ দান বা পোড়ন কাটার জন্য লিখিত কোনো সাধারণ ছড়া নয়। প্রতিটি ছড়ার শিক্ষণীয় বিষয়ের সঙ্গে আনন্দ আর মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের নানা সমস্যার কথাও বিন্যস্ত হয়ে থাকে থরে থারে :
“পাশে পাসে ভিন্ন শিখে
করব এবার পাস
তা না-হলে লেখা-পড়ায়
হবেই সর্বনাশ।” (পাশে পাসেও ভিন্ন, বানান নিয়ে বানানো কথা)
ভাষা, ভাষপ্রেম, দেশীয় সাহিত্য ও সংস্কৃতি শাহিদুল হকের ছড়ার মূল অভিধা। প্রকাশ করার বিরল প্রতিভা রয়েছে তার মগজে আর কলমে। শব্দকে কীভাবে ছন্দ আর মন্দ্রণে ঢুকিয়ে নিজের ইচ্ছামতো জ্ঞান-অর্থ আর আনন্দদানের নির্মল উপকরণে পরিব্যপ্ত করতে হয়- তা শাহিদুল হকের মতো আর কয়জনই বা জানেন- তা আমার জানা নেই। ব্যাকরণের সারিতে গল্প, গল্পের সারিতে ছন্দ, ছন্দের সারিতে ফোড়ন, সমাজের অসঙ্গতির স্ফুটন; এ এক
অভাবনীয় বিন্যাস। পড়লে আনন্দ আহরণ আর জানার ইচ্ছা আরও প্রবল হয়ে ওঠে :
“গোঁড়ামি আর ন্যাকামিতে
ভণ্ডামিতেও ‘আমি’
ইতরামি আর চোরামিতেও
হ্রস্ব ই-কার দামি।” (‘আমি’ ‘আলি’ ‘ইত’ ‘আনি’, বানান নিয়ে বানানো কথা)
ছোট গল্প রচনা ও কৌতুক চয়নেও শাহিদুল হকের রয়েছে স্বকীয় ঢঙ। এখানে তিনি তীব্র, কটাক্ষের কাঁটায় সমাজকে বিদ্ধ করে সজাগ করার ভূমিকায় অবর্তীর্ণ। গবেষক হিসাবেও তিনি অন্যরকম। বিষয়ের ভিতরে ঢুকে গভীরতার বিষয়টাকে শুধু তুলে আনেন না, কারণের কারণগুলোও বুঝে নেন। একটি রক্তমাংস, অন্যটি প্রাণ। অধিকাংশ গবেষক শুধু দৃশ্যময় বস্তুগুলো নিয়ে ভাবেন, লিখেন- কিন্তু শাহিদুল?
তিনি দৃশ্যমান বিষয়গুলোর অন্তরালে যে স্পন্দন নিয়ত নিনাদিত হয় চোখের আড়ালে, তার সঙ্গেও সেতুবন্ধন রচনা করেন- অবলীলায় অন্তর দিয়ে। তার লেখা ‘লালন কী জাত সংসারে’ গ্রন্থটি পড়লে শাহিদুলের এ বহুমুখী গভীরতা পরিচয় পাওয়া যায়।
ব্যাকরণকেও তিনি সমাজ বিনির্মাণ আর শুদ্ধতার ক্ষেত্রে প্রসারিত করার চেষ্টায় নিবেদিত। যার আচরণ শুদ্ধ তিনি ভালো মানুষ। যার কথা শুদ্ধ তিনি শুদ্ধতার সমৃদ্ধি। যিনি মাতৃভাষাকে শুদ্ধভাবে আয়ত্তে আনার চেষ্টা করেন না তিনি কখনও ভালো মানুষ হতে পারেন না। যিনি মাতৃভাষা শুদ্ধ বলতে না-পারার জন্য নিজের অবহেলাকে গোপন করে, মাতৃভাষাকে ‘জটিল’ অপপ্রচারে হেয় করেন, আত্মশ্লাঘায় ভোগেন – তিনি দেশদ্রোহী। এমন ভাষাহীন লোকদেরকে সপ্তদশ শতকের কবি আবদুল হাকিম জারজ বলে গালি দিয়েছিলেন। মাতৃভাষাকে অবহেলাকারীদের বিরুদ্ধে আবদুল হাকিমের মতোই মনোভাব দেখা যায় শাহিদুল হকের ছড়ায়। মাতৃভাষার প্রতি অবহেলা দেখে তিনি ব্যথিত। ঝরে পড়ে ক্ষোভ, ঘৃণা। তবু তিনি হতাশ নন, বাংলাভাষীদের জাগিয়ে তোলার চেষ্টায় এগিয়ে চলে তার কলম ও কলাম। ভাষাবিদগণের
বাংলা বানানের সাংঘর্ষিকতামূলক মনোভাব নিয়েও তিনি ক্ষুব্ধ:
মাষ্টাপিচ দাহন
ReplyDeleteদারুণ। মুগ্ধ
ReplyDeleteকৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। শুধুই কৃতজ্ঞতা। সাথে শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে দু ফোঁটা আনন্দাশ্রু।
ReplyDeleteকৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। শুধুই কৃতজ্ঞতা। সাথে শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে দু ফোঁটা আনন্দাশ্রু।
ReplyDeleteশাহিদুল ভাইয়ের 'বানান নিয়ে বানানো কথা' বাংলা মায়ের জন্য শতাব্দীর সেরা উপহার।
ReplyDelete