কবিতা কী?
প্রীতির বিভরে প্রেমের উচ্ছ্বাস
আর?
দ্রোহের আগুনে নিদাঘ নির্যাস।
প্রকৃতপক্ষে কবিতা একটি শক্তি, শক্তির অনুমন। কবিতা তার শব্দের শক্তি নিয়ে নদীর গতিতে সমুদ্র বানায় মরুভূমির বুকে, সবুজের মেলায় ভরিয়ে দেয় অনুর্বর মাটির চৌচির বক্ষ। প্রেম আর সখ্যের নিপূন বক্ষে কবিতা এঁকে দেয় রঙের দ্যোতনা। কবি পূর্ণা রায়ের কাব্য
‘প্রৈতি’ পড়ে আমার এমনটিই মনে হয়েছে। তার কাব্যশক্তির নিস্তব্ধ প্রতীমা শব্দের প্রবল শক্তিতে যখন বিভোর হয়ে ওঠে, তখনই গতি পায় হৃদয়, উথলে ওঠে বিগলিত মাধুর্যের নিটোল সুন্দর আর হাতের দিকে ছুটে আসে কলম, মনে ভিড় জমায় ছন্দ। এ অবকাশে কবি পূর্ণা রায় ভালবাসার মমতায় সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব উড়িয়ে শান্তির বিহব্বল অবকাশে উদাস হয়ে যেতে চান প্রকৃতির মধুর অভিলাষে কবিতার খাতায়। এখানে বিভেদের সব রেখা নিশ্চিহ্ন, জীবন শুধু মমতার শিকড়ে খুঁজে বেড়ায় রস। কবির ভাষায় :
“ভয় পেয়ো না প্রিয় ...
আমাদের আলিঙ্গনে হবে
সুবাতাসের চাষ।” [পূর্ণা রায়, এমন সাধ্য কার, প্রৈতি]
পূর্ণা রায় অনুভূতিতে সরব, সুভাষে তার মুখরতাগুলো কাব্যিক ছন্দের নির্বাক হিল্লোল তুলে আগামীর, আগমন আর প্রত্যাশার। মানুষকে জানার, জানবার এবং কাছে টানার অনবদ্য এক অভিলাষ তাকে বিভোর করে তোলে কবিতার মতো প্রমুগ্ধ প্রগলভতায়। প্রেমের মতো প্রকৃতিও তার কাব্যের মসলা, জীবনবোধে উদ্বুদ্ধ পূর্ণা রায়ের প্রীতিময় সোহাগ শিলং পাহাড়ের সুদূর কোণায় মেঘদূত হয়ে ছোট হৃদয়েও ভীষণ ঢেউ তোলে। তিনি তখন আনমনা হয়ে যান নিরুদ্বেগ ভাবুলতায়, চোখ বন্ধ করে অদৃশ্য দর্শনে নেচে ওঠেন নৃত্যের গর্জনে মেঘের কুহুরে। সীমাহীন সীমায় ফেনিল রাশির ন্যায় রাশি রাশি অণু, তার অনুভবের দ্বারে দ্বার নাড়ে। তখন হৃদ্যতার আকণ্ঠে ডুবিয়ে দিতে চান তিনি তার কবিতার সব মেঘমালা :
“কেমন আছো অমিত রয়?
পোকা কাটা
হলদে কাগজ থেকে বেরিয়ে এসো
প্রকট হও
শিলং পাহাড়ে মেঘদূত জমবে আজ
প্রলাপে মেতেছে তোমার ঘন ঘোর বরষা” [ পূর্ণা রায়, কেমন আছো?, প্রৈতি]
পূর্ণা রায় ‘প্রৈতি’র সাঝে এবং সাজের ভাঁজে শুকিয়ে যাওয়া রূদ্রাক্ষের মালাতেও সজীবতার ছোঁয়ায় শিউরে ওঠেন রমণীয় প্রকৃষ্টতায়। ভালবাসা তার নদীর মতো। যে নদী জলম্বুর, জলে জলে জলময় কেবল সে নদীই জলধি হতে পারে; জলময় উর্বরতায় ভরিয়ে দিতে পারে চারিপাশ পলির চুমোয়। তাই যার মধ্যে ভালবাসা আছে কেবল সে-ই ভালবাসার
জন্য জীবন দিতে পারে। এ ভালবাসা কবির মতো নিস্পৃহ কিন্তু বাতাসের মতো অনিবার্য আর জলের মতো পরম। ‘প্রৈতি’ কাব্যের ‘ভালবাসা’ শিরোনামের কবিতায় কবি পূর্ণা রায় ভালবাসার যে সংজ্ঞার্থ এবং ক্রিয়াপ্রকরণ বিধৃত করেছেন তা জীবনের চেয়েও অমোঘ, মৃত্যুর চেয়েও কঠিন। প্রাত্যহিক জীবনের নানা টানাফোড়েনের টানে টানে ভালবাসার রূপ কীভাবে বদলায়, কীভাবে ভালবাসা আকাশের মতো নানা বৈচিত্র্যময় ঢঙে পরম কাছের হয়েও চরম দূরের হয়ে যায় Ñ তা হতভম্ব করে দেওয়ার মতো উপমায় বর্ণনা করা হয়েছে এ কবিতায়। মানুষের সম্পর্কের নানা সাংঘর্ষিক দিকের বর্ণনা দিতে গিয়ে কবি তার কবিতায় বাগানের মতো রঙীন ক্ষেত্রে মালির প্রয়াসে গড়ে তুলেছেন অনবদ্য এক শব্দ বাগান :
জন্য জীবন দিতে পারে। এ ভালবাসা কবির মতো নিস্পৃহ কিন্তু বাতাসের মতো অনিবার্য আর জলের মতো পরম। ‘প্রৈতি’ কাব্যের ‘ভালবাসা’ শিরোনামের কবিতায় কবি পূর্ণা রায় ভালবাসার যে সংজ্ঞার্থ এবং ক্রিয়াপ্রকরণ বিধৃত করেছেন তা জীবনের চেয়েও অমোঘ, মৃত্যুর চেয়েও কঠিন। প্রাত্যহিক জীবনের নানা টানাফোড়েনের টানে টানে ভালবাসার রূপ কীভাবে বদলায়, কীভাবে ভালবাসা আকাশের মতো নানা বৈচিত্র্যময় ঢঙে পরম কাছের হয়েও চরম দূরের হয়ে যায় Ñ তা হতভম্ব করে দেওয়ার মতো উপমায় বর্ণনা করা হয়েছে এ কবিতায়। মানুষের সম্পর্কের নানা সাংঘর্ষিক দিকের বর্ণনা দিতে গিয়ে কবি তার কবিতায় বাগানের মতো রঙীন ক্ষেত্রে মালির প্রয়াসে গড়ে তুলেছেন অনবদ্য এক শব্দ বাগান :
“ভালবাসার অনেক ডালপালা হয়
উড়াল ডানা হয়, শেকড়-বাকড় হয়
অনেক লম্বা হাত হয়, দানবের দাঁতের মতো
শক্ত দাঁত হয়; নখরও হয়
ভালবাসা বাতাসে ওড়ে;
ক্লান্ত শরীর টেনে কখনও একটু জিরোয়” [পূর্ণা রায়, ভালবাসা, প্রৈতি]
মানবতায় আপ্লুত কবির হৃদয় ভালবাসার সাম্যে কানায় কানায় পূর্ণ হলেও মাঝে মাঝে কিছু ক্ষোভ তার কাব্যে
লবণের মতো লাবণ্যময় দ্যোতনা টেনে দেয়। যা তার কবিতাকে করে তুলে আরও হৃদয়গ্রাহী আরও জীবনমুখী এবং বাঙ্ময়। দুঃখ আছে বলেই সুখের আকাঙ্ক্ষা এত তীব্র, অশান্তি আছে বলেই শান্তি এত মিষ্ট। ভালবাসা দিয়ে সব জয় করা যায়। তাই ভালবাসার জন্য তিনি জীবন দিতে পারেন। শুধু পার্থিব প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা মানুষকে পশু করে দেয়, এটি জীবন নয়; পচনশীল লাশের বিরক্তিকর অনুভূতি। তাই কবি পূর্ণা রায় শুধু পার্থিব প্রাপ্তি নয়, হৃদ্যিক মননশীলতা দিয়ে পার্থিব বিষয়কে উপস্থাপন করেন সর্বজনীন সাদরে :
লবণের মতো লাবণ্যময় দ্যোতনা টেনে দেয়। যা তার কবিতাকে করে তুলে আরও হৃদয়গ্রাহী আরও জীবনমুখী এবং বাঙ্ময়। দুঃখ আছে বলেই সুখের আকাঙ্ক্ষা এত তীব্র, অশান্তি আছে বলেই শান্তি এত মিষ্ট। ভালবাসা দিয়ে সব জয় করা যায়। তাই ভালবাসার জন্য তিনি জীবন দিতে পারেন। শুধু পার্থিব প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা মানুষকে পশু করে দেয়, এটি জীবন নয়; পচনশীল লাশের বিরক্তিকর অনুভূতি। তাই কবি পূর্ণা রায় শুধু পার্থিব প্রাপ্তি নয়, হৃদ্যিক মননশীলতা দিয়ে পার্থিব বিষয়কে উপস্থাপন করেন সর্বজনীন সাদরে :
“আজ বাতাসের আনাগোনা অন্যরকম,
অন্য সুরের আভাস ছিল
তোমার গোপন চলা নদীর চরে” [পূর্ণা রায়, অন্যরকম বাতাস, প্রৈতি]
শব্দচয়নে
কবি বেশ আবেগময়। তবে আবেগের মাঝেও তার রয়েছে পূর্ণ সচেতনতা এবং সজাগ মাদকতা। যার চারিপাশ
ঘিরে রূপোলি বিকেলগুলো তার ভোরের শিশির-স্নাত ঘাসে সবুজের মায়ায় অন্যরকম আবেশ টেনে
দেয় প্রাণে। যতই কিছু হোক, যাই ঘটুক তিনি প্রবল আত্মবিশ্বাসে অনুসময় হিমেল হিমালয়
:
“নিঃসঙ্গ
রাত, কালো অন্ধকার যাচে- স্থবিরতা
হুঁতোমপেঁচাকে
বলে; চোখটা তোর বন্ধ রাখ” [পূর্ণা রায়, অন্ধকারের গ্রাসে, প্রৈতি]
কবিতা
মানুষের মনের প্রকাশ, প্রকৃতি তার সহায়ক উপলব্ধি। বস্তুত এ দুটি ঘিরে পরিবেশ-প্রতিবেশ।
তাই কবি, কবিতা এবং জীবন ও প্রকৃতির মধ্যে মূলত কোন তফাত নেই। সবার মিলনই কবিতা এবং
কবিতাই জীবন। কবি পূর্ণা রায় তার কাব্যে এটিই দেখিয়েছেন, শব্দের গোছায় ছন্দ লাগিয়ে
দারুণ এক মমতায় :
“তুমি
বৃষ্টি হয়ে ঝরবে তাই
চুল
গেছে খুলে” [পূর্ণা রায়, কতদিন পর, প্রৈতি]
উপমা
কবিতার অলঙ্কার। কবিরা শব্দের বন্যায় বাক্যের বাঁকে বাঁকে উপমা বসিয়ে একটি সাধারণ বিষয়কেও
অসাধারণ করে তুলতে পারে। উপমা যত সুন্দর হয়, যত আলোময় হয়, যত নিকষ হয়-
কবিতার রস তত
লাস্যময় হয়ে ওঠে। এ উপমা মানুষের অনুভূতিকে জীবনের স্তরে স্তরে রক্তের মতো ছড়িয়ে দিয়ে
দূষিত জিনিসগুলো নিয়ে আসে। কবিতায় উপমা প্রয়োগে কবি পূর্ণা রায় যেমন বিচক্ষণ তেমন বিলাসী
আবার রসময় সচেতন। কোথায় কখন কোন উপমা আনতে হবে সে বোধ তার কবিতার একটি অনবদ্য অলঙ্কার।
এ অলঙ্কার পূর্ণার কবিতাকে প্রথম প্রেমেপড়া কিশোর-কিশোরীর মতো আবেশিত করে রাখে ঘন নিঃশ্বাসের
অতুল কাব্যবক্ষে :
“কাল
বিকেলে
আমার
সদ্য ফোটা স্বপ্নগুলো
যখন
তোমার হাতে গুঁজে দিলাম
এক-আধটু
ভেজা ছিল,
তুলতুলে
ওই স্বপ্নগুলো
কেমন
আছে?” [পূর্ণা রায়, জানতে দিও, প্রৈতি]
গতকালই
পেয়েছি পূর্ণা রায়ের কাব্যটি। খামে আপেলের মতো নির্ঝর শব্দে লেখা ঠিকানাগুলোই বলে
দিচ্ছিল কবি সুন্দরের খুব নিকটে সুন্দরেই লালিত। তাই সৌন্দর্যবোধ তাকে অবিরাম গুছিয়ে রাখে। তার কবিতার শব্দচয়ন কৌশলেও এমনটি দেখলাম। প্রচ্ছদটাও হয়েছে অসাধারণ, দেখামাত্র বোধের উন্মেষ ঘটায় পলকে পলকে পত পত জ্যোছনায়। তবে কিছু মুদ্রণ প্রমাদ আছে, অবশ্য বাংলা ভাষায় মুদ্রণ-প্রমাদহীন কোনো গ্রন্থ আমার চোখে পড়েনি। যাই হোক, চৌষট্টি পৃষ্ঠার ‘প্রৈতি’র চৌষট্টি কবিতা যেন চৌষট্টি শতকের ভাবনার অনিমেষ সারবিন্দু। যার পরতে পরতে শিহরণের উষ্ণ শ্বাস। পড়তে পড়তে একসময় শেষ হয়ে গেল। ইস্ আরও কয়েকটি যদি থাকত! তাহলে আরও ভালবাসা নেয়া যেত, কিন্তু তা কী হয়! পূর্ণা রায়ের মনোহর ভাষায় বলা যায় :
দিচ্ছিল কবি সুন্দরের খুব নিকটে সুন্দরেই লালিত। তাই সৌন্দর্যবোধ তাকে অবিরাম গুছিয়ে রাখে। তার কবিতার শব্দচয়ন কৌশলেও এমনটি দেখলাম। প্রচ্ছদটাও হয়েছে অসাধারণ, দেখামাত্র বোধের উন্মেষ ঘটায় পলকে পলকে পত পত জ্যোছনায়। তবে কিছু মুদ্রণ প্রমাদ আছে, অবশ্য বাংলা ভাষায় মুদ্রণ-প্রমাদহীন কোনো গ্রন্থ আমার চোখে পড়েনি। যাই হোক, চৌষট্টি পৃষ্ঠার ‘প্রৈতি’র চৌষট্টি কবিতা যেন চৌষট্টি শতকের ভাবনার অনিমেষ সারবিন্দু। যার পরতে পরতে শিহরণের উষ্ণ শ্বাস। পড়তে পড়তে একসময় শেষ হয়ে গেল। ইস্ আরও কয়েকটি যদি থাকত! তাহলে আরও ভালবাসা নেয়া যেত, কিন্তু তা কী হয়! পূর্ণা রায়ের মনোহর ভাষায় বলা যায় :
“ঝাপসা
চোখে তৃষ্ণা মেটানো যায়,
ভালবাসাকে
ভালবাসা যায়- ছোঁয়া যায় না” [ভালবাসাকে ছোঁয়া যায় না, প্রৈতি]
পূর্ণা
রায় “প্রৈতি”র উপহারে পূর্ণ প্রীতিতে ভরিয়ে
দিয়েছে আমার মন। ভালবাসার মননশীলতায় বিভোর কবি পূর্ণার কাব্যকন্যা “প্রৈতি” আমাকে অনেক
আনন্দ দিয়েছে, অনুভবের খোড়াক দিয়েছে। পূর্ণার প্রতি রইল অনেক অনেক ভালবাসা। কারণ :
“ভালবাসতে
জানে যে-
তাকে
ভালবাসতেই হয়।” [পূর্ণা রায়, ভালবাসা, প্রৈতি]
আমার প্রত্যাশা, আরও এগিয়ে যাক পূর্ণা রায়
ভালবাসার কবিতায়
আমাদের সবার মাঝে
সারাক্ষণ, রাতে, সন্ধ্যায় এবং সাঝের সাজে।