Monday 15 February 2016

এম এল গনি : জীবনবোধে উদ্দীপ্ত অনুভূতির প্রমুগ্ধ দার্শনিক


এম এল গনি, পুরো নাম মোহাম্মদ লোকমান গনি। বাংলাদেশে জন্ম, কানাডায় থাকেন দীর্ঘদিন। পেশায় প্রকৌশলী কিন্তু নেশায়?

এ কথাটি বলার জন্য কলাম ধরা। প্রকৌশলীর মতো নিবিড় ও বিশেষায়িত কাজে মগ্ন থেকেও তিনি লিখেছেন একটি বই, বই মানে বিজ্ঞানের বা যন্ত্রের কোনো বই নয়,
সাহিত্যকর্ম, আবার যেনতেন সাহিত্যকর্ম নয়, সাহিত্যের রাজা গল্প। তার গ্রন্থের নাম ‘কচি চেহারার বিড়ম্বনা’। নামেই একটা মাদকতা, কেমন বিড়ম্বনা কচি চেহারায়? তা জানার জন্য পড়তে বাধ্য হলাম বইটি। পড়তে পড়তে অবশেষে নিজেকে আবিষ্কার করলাম- এম এল গনির মাঝে, তিনি লেখক, তিনি দার্শনিক, তিনি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে চোখরাখা এক বিদর্শী অভিভাবক। চলতে চলতে আমরা চলি, গনি চলেন না শুধু; চোখকান খোলা রেখে দেখেন, বলেন এবং শেখান। এখানেই পার্থক্য আমাদের এবং গনিদের। ‘কচি চেহারার বিড়ম্বনা’ একটি গল্পসংগ্রহ। তবে কোনো রূপকথার গল্প নয়, জীবন থেকে নেওয়া আমাদের চারপাশে সতত সঞ্চরণশীল ঘটনার গভীর রেখাপাত। প্রত্যহ কত ঘটনা ঘটে যাচ্ছে আমাদের চারপাশে- কয়টাই বা আমরা দেখি, কয়টা বা বুঝতে পারি- কিন্তু যাদের অর্ন্তদৃষ্টি আছে, আছে সহানুভূতির মর্মবোধ তাদের চোখে কিন্তু কিছু এড়ায় না। জীবন তাদের কাছে প্রকৃতির সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য একটি ক্যানভাস। তাই তাদের তুলি অতুলনীয় হয়ে ওঠে ক্যানভাসের পরতে পরতে সজ্জায় সজ্জায়। এম এল গনি এমন একজন অনুভূতিপ্রবণ লেখক, যার দৃষ্টি কানাডার জলপ্রপাতের মতো স্বচ্ছ এবং চিন্তা প্রকৃতির মতো নিবিড় আর উদারতা বাক্যের মতো নির্মল।

‘কচি চেহারার বিড়ম্বনা’ তার প্রথম গ্রন্থ। ২৭টি ভিন্ন স্বাদের ভিন্ন অনুভূতির গল্প নিয়ে বইটির অবয়ব। প্রতিটি গল্পে গল্পকার নতুনভাবে নতুন আঙ্গিকে পরিবেশ-প্রতিবেশ ও প্রাত্যাহিকতাকে বিশ্লেষণ করেছেন। গল্পগুলো হচ্ছে : কচি চেহারার বিড়ম্বনা, কুপোকাৎ, মারপ্যাচ, সততার সিন্ধুঘোটক, যুক্তিতে মুক্তি, নাপিত বন্ধুর আক্ষেপ, একটি ফেইসবুকীয় কল্পকাহিনি, কাজ তো কাজই, কাঙ্গাল, মুক্তিযুদ্ধের শিশুবীর, ভাইবোনের গিফট, একচিলতে শৈশব, স্কুলিং : এদেশ-ওদেশ, গোলমেলে, ইহুদি-নাসারার দেশ, বয়সবিষয়ক প্যাঁচাল, ঠোঁটকাটা, কমলা, অভিযোগ, খোয়াব, দুর্বিপাকের একদিন, লেঅফ প্রুফ মনি ভাই, কলাম্বিয়া  আইসফিল্ড দর্শন ও কিরণের পর্বত অবরোহণ, ফুলিনি ও চৌধুরী নানার গল্প, চেনা-অচেনা, জলের মানুষ এবং একুশের ভাষণ। প্রথম গল্পে তিনি নিজেকে নিজের মতো করে সম্পূর্ণ স্বকীয়তায় প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন। প্রথম গ্রন্থে এরকম কৃতিত্বের সাক্ষর রাখা সবার পক্ষে সম্ভব হয় না। লেখক প্রকৌশলী হলেও গ্রন্থটি পড়লে মনে হবে তিনি শুধু যন্ত্র নিয়ে, কাঠ বা লোহালক্কর নিয়ে থাকেন না, মানুষের মন নিয়েও তার প্রচুর অভিজ্ঞতা এবং নিবিড় অধ্যয়ন আছে। যন্ত্রের মতো প্রতিটি ঘটনাকে তিনি খুটিয়ে খুটিয়ে আবেগঘন চোখে মন দিয়ে অনুভব
করেন। গল্পগুলো পড়লে অবাক হয়ে যেতে হয়, তিনি এত ব্যস্ততার মাঝেও কীভাবে জীবনকে এত আয়েসের মাধ্যমে অনুভব করার ইচ্ছাকে সতেজ রাখতে সক্ষম হয়েছেন। নিশ্চয় তার কৃষ্টি আর ঐতিহ্যের সঙ্গে অধ্যয়নের বিরল যোগসূত্র এমন অনবদ্যতার কারণ। তিনি লিখেছেন মনের আবেশে নিলয় বিকাশে। যা দেখেছেন  অবিকল তুলে ধরেছেন নিজের মনে তবে ঘটনার ভাষায়, বিস্তৃত অবলীলায়। কানাডা-আমেরিকায় বসবাসরত বাঙালির প্রাত্যহিক জীবন, চালচলন, দৃষ্টিভঙ্গি, আর্থসামাজিক অবস্থা, ধর্মীয় টানাপোড়েন, সাংস্কৃতিক বিম্বতা, দ্বান্দ্বিক মৌনতা প্রভৃতি এবং ওই দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনামূলক অবস্থানকে ঘটনায় ঘটনায় অপূর্ব কৃতিত্বে তুলে ধরেছেন এম এল গনি, তার কচি চেহারার বিড়ম্বনায়।  এম এল গনির লেখায় আধুনিকতা একটি প্রোজ্জ্বল বিকাশ। তবে, আর একটি বিষয় না-বললে নয়, লেখক শুধু আধুনিকতায় সীমাবদ্ধ থাকেননি। তিনি দৃষ্টিভঙ্গি আর প্রাত্যহিকতাকে অতীতের মাঝে ডুবিয়ে, অতীতের কোড়কে এনে বর্তমানের থালায় ভবিষ্যতের জন্য পরিবেশন করেছেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মন্দ্রিত আবেগ বর্ণনার বর্ণছটায় উথলে উঠেছে, হয়তো কিছুটা বা উছলেও। তবে এটি লেখকের উচ্ছ্বাসের তারুন্যে উপলব্ধির নিকষ বর্ণনার প্রয়াস। এটি তার তারুণ্য এবং আবেগের কারণে ঘটেছে। যা গল্পকে কিন্তু আরও রসালো করে তুলেছে। একজন তরুণী বইটি কিনছিলেন, আমি তার কাজে জানতে চাইলাম কেন কিনলে বইটা? ‍তুমি কী লেখকের পরিচিত?না। নামটা দেখে মুগ্ধ হয়ে।  আমাকেও চেহারা নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়ে। আমি জানতে চাইছি, লেখক কচি চেহারা নিয়ে কী বিড়ম্বনায় পড়েছেন এবং এত সুন্দর একটা নাম কীভাবে দিতে পেরেছেন। তার নামটি আমাকে ছুঁয়ে গেছে। পরদিন তরুণী আমাকে জানালেন বইটি পড়ে তিনি মুগ্ধ হয়েছেন। আরও বলেছেন, আজকের পাঠকের কেন হুমায়ুন-জাফর মার্কা সস্তাদরের ও নিম্নমানের বই পড়েন বুঝতে তার কষ্ট হয়। তার চোখে এম এল গনির বইটি তথাকথিত বর্তমান হুমায়ুন কিংবা জাফর ইকবালের বইয়ের তুলনায় অনেক বেশি আবেদনময়। লেখা, লেখকের মুখচ্ছবি।  কচি চেহারার বিড়ম্বনা এম এল গণির অবয়ব। তার লেখায়, তার বাক্যে আর শব্দে আছে প্রাত্যহিক জীবনের সাংঘর্ষিকতায় মানুষের বিপ্রতীপ কর্মকাণ্ডের সপ্রতীভ অনুধ্যায়।

 বইটির ফ্ল্যাপ-বাণী দিয়েছেন আনিসুল হক। এম এল গণি লেখক হবার জন্য লেখেননি। 
মনের আনন্দে জীবন ও বাস্তবতা হতে উৎসরিত প্রেরণাকে স্থায়িত্ব দেওয়ার জন্য লিখেছেন। তাই তার লেখা অনেক স্নিগ্ধ, অনেক নিবিড়, নিপুণ আর নির্ঝর। তিনি লিখেছেন হৃদয়র গভীর থেকে সচেতন কৃষ্টতায়, সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য নয়। এখানেই তফাৎ সস্তাজনপ্রিয়তা প্রত্যাশী লেখক আর এম এল গনিতে। 

আহমদ ছফা বলতেন, বাংলাদেশে জনপ্রিয় হতে হলে রিক্সাওয়ালা মানের বই লিখতে হবে, কারণ এখানকার অধিকাংশ পাঠক ওই মানের। সে তুলনায় এম এল গনির গল্প অনেক বেশি জীবনধর্মী। জীবনের গভীর গভীরতার অতল অতলান্ত থেকে তিনি তুলে এনেছেন বিন্দু বিন্দু রসদ। কচি চেহারার বিড়ম্বনা গল্প নয় শুধু, গভীর অনুভূতির প্রমুগ্ধ কাব্য। ভবিষ্যত তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। 

3 comments:

  1. অনেক কষ্ট করে দেশের বাইরে থেকেও বইটি যোগার করে পড়লাম। আমরা সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছের সাথে তুলনীয় কিছু পেলাম বহু বছর অপেক্ষার পর। গল্পগুচ্ছের অনেক গল্পই এখন কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাবার দশা। সেই জায়গা নিতে পারে বা আমি বলতে পারি ইতিমধ্যেই নিয়ে নিয়েছে 'কচি চেহারারা বিড়ম্বনা'। বাংলা সাহিত্যে মল গুনি একটি অসাধারণ সংযোজন হয়ে থাকবে। আমার শুধু আফসোস কেন আরও ১০ বছর আগে লেখক লেখা শুরু করলেন না। তাহলে হয়ত জীবন সম্পর্কে আমার ধারণা অন্যরকম হতে পারত।

    ReplyDelete
  2. ভাগ্যিস আমার সময় লোকমান গণি সাহেব ছিলেন না। বড় বাঁচা বেঁচে গেছি।

    ReplyDelete
  3. https://www.rokomari.com/book/114408/

    ReplyDelete