Tuesday 2 February 2016

শামসুল আলম সেলিম : কবিতার তৃপ্তি, আধুনিকতার সারল্য

শামসুল আলম সেলিম কবিতার মানুষ, মানুষের কবিতা এবং গদ্যের নীরবতায় এক নির্ঝর প্রতিভা। সহজভাবে কিছু প্রকাশ করা কত
কঠিন তা রবীন্দ্রনাথ প্রকাশ করে গেছেন, ‘সহজ কথা যায় না বলা সহজে/ সহজ কথা বলতে আমায় কহ যে”। কিন্তু সেলিম, অন্যরকম, তিনি প্রবৃত্তির কবি, দ্বিধাহীন প্রকাশে সতত মুখর। সহজতা তার সহজাত, প্রকাশ তার যেমন আনুষ্ঠানিকাতহীন তেমনি প্রেমময়, আবেগ-উচ্ছল। তার শব্দগণ্ধ এত বৃত্তিময় যে তিনি খুব সহজে অনেক জটিল বিষয়কে নির্ঝর বিকেলের মতো পরিষ্কার করে তুলতে পারেন সবার কাছে। মানুষ কত উদার হলে আর কবি কত নিদাঘ হলে এমন করা যায়?
ফিরে আসো সোনালী সময়/ আমি ভালোবেসে মরে যেতে চাই' কবি শামসুল আলম সেলিমের ‘তুমি ফিরে আস’ কবিতার শেষ দুটি চরণ। চরণ নয়, যেন মরন। এ মরন সাধারণ কোনো মরন নই, আপ্লুত ছন্দে বিভোর হয়ে যাওয়া শতাব্দীর সুর। এর শুরু আছে শেষ নেই। প্রতিটি লাইন এক একটা স্বপ্ন হয়ে আনমনা করে দেয় স্মৃতিকে। এ এক অদ্ভুদ মাদকতা :
“তুমি আমার বসন্ত নও
চৈত্র মাসের পাখা।।”
আর কত সহজে বলা যায় মনের কথা। কেউ কি পারবেন? আমি তো ভাবতেই পারি না, এত সহজে কীভাবে এমন মুগ্ধকর প্রকাশ ঘটান সেলিম, মাত্র সাতটি শব্দে পুরো জীবনকে রে দিয়েছেন আগ্রহের কৌটায়তিনি সহজবোধ্যতার আধুনিক কবি, কবিতার পঙ্‌ক্তিতে গড়ে তোলা মিনারে ভালবাসার চোখ, চোখের পলকে মুচকি হাসির শিহরণ।তাই আমি তাঁকে বলতে পারি কবিতারূপী রমণীর তৃপ্তিময় শিৎকার। এখানে ভালবাসা দ্রোহ হয়ে এবং প্রেম হৃদয়ের মই হয়ে চষে বেড়ায় সবুজের প্রত্যাশায়। সৃষ্টি অসহায় হয়ে তাকিয়ে থাকে।

শামসুল আলম সেলিম কবি। শুধু কী কবি? কবিরা অনেকে আত্মভোলা হয়, অনেকে হয় আত্মমুখী। শামসুল আলম সেলিম, সে অর্থে ভিন্নতার দাবিদার। তিনি কবি হয়েও কবিতার মাঠে বিচরণ করেন বাতাসের শব্দে।গৃহিনীর পাতিল হতে শুরু করে আধ্যাত্মিক জগতের রহস্যময় দুনিয়াতেও তার সাবলীল পদচারণা, দীপ্ত সবাক উক্তি :
এক ভান্ডতেই চন্দ্র সূর্য 
রয় সাধু-চোর কি আশ্চর্য
মনভোলা তাঁর ভাব না বুঝে,
কি খেলে সাঁই আপন ঢঙ্গে ।। (গান : দেহতত্ত্ব)

সেলিমের কবিতা অবিরাম, অবিকল এবং অবিশ্রান্ত সৌন্দর্য। গৃহ হতে শুরু করে অনুষ্ঠানের কানায়, সভার মাঝে, সংগীতের তীরে, রাজনীতির মাঠে, কবিতার আসরে, বন্ধুদের আড্ডায়, গানের জলসায় -সবখানে তার সরব উপস্থিতি। কোনো ক্লান্তি নেই, কবিদের আবার কিসের ক্লান্তি! তার মানবপ্রেমী মন আর সার্বজনীন অনুভূতির স্মারক হয়ে তাই আরও কিছু আবিষ্কারের জন্য সবখানে ঘুরে বেড়ায়। কবিতাতেও তিনি অনুরূপ। সবরকম কবিতা লেখার যোগ্যতা রাখেন। তাঁর প্রতিটা কবিতায় মানুষ, ্প্রেম, প্রকৃতি আর দ্রোহের মিশ্রণ বিভোর হয়ে ওঠে সহগমনে। না, সহমরন নয়, লালিত্য এখানে বহুমুখী হয়ে ধরা দেয় পাঠকের নাগালে :
আঙুল ছোঁয়াও
গতরে স্পর্শ লাগে
আগুন পোহাও
কুয়াশা গহিন মাঘে
চাদরটা কার ভাগে ? 
এ পঙ্‌ক্তিগুলো কী শুধু শব্দ? শুধু ছন্দ? কবির আকুতি, কী ভীষণ অনুভূতিতে উথলে উঠেছে, তা কোনো বোদ্ধা পাঠকের মন এড়িয়ে যেতে পারে না। আমি অভিভূত হয়ে তার লাইনগুলো দেখি-শব্দরা সেখানে মানুষের জন্য সেলিমের শব্দবাগানে প্রার্থনা করে, যুদ্ধ করে,
প্রেম করে আর করে লীলা। এ লীলা সৃষ্টির উল্লাসে ধ্বংসের বিপর্যয়। তাই তার কবিতায় সবসময় মানুষ, বিশেষ করে দলিতরা উচ্চকিত। তাঁর ‘আয়না ঘর দুয়ার খোলা’ কাব্যে বর্তমান যেন আগামীর ভোর আর অতীত। সে আরও জীবন্ত হয়ে ভিত্তিকে করে দিচ্ছে পাথর। এগিয়ে যাও, আরও এবং শেষ পর্যন্ত।
যৈবতী নাদান
মাটির ঘড়ায় গড়ে
সখের বাগান।
বুকের গহীনে পড়ে
সুখ বুঝি নড়েচড়ে। (অন্ধের কুর্নিশ)
শামসুল আলম সেলিম কবির কবি। একথা বলার অর্থ আছে। তিনি শুধু কবিতা লিখেন না, গানও লিখেন, আবার সুরকারও। তার গানে কবিতার অনুভূতি অন্যভাবে হাসে, অন্যভাবে নাচে, বিপুল উৎসাহে হৃদয়ের খুব গভীরে নাড়া দেয়, সহজবোধ্য ভাষা আর টলমল জলের স্নিগ্ধতায় ভরে ওঠে প্রাণ :
বাঁশরিয়া বুঝবে কি গো এই রাধার মিনতি
মান কূলমান সবই গেলো ভুল বুঝিল পতি,

মনভোলা কয় শ্যাম বিনে রাই ঝাপ দিবো কি জলে’

চক্ষু ভাসে জলে গো চক্ষু ভাসে জলে ।।


তাঁর কাছে কবিতা অনুভূতির কলমন্দ্রস্বর। এখানে ভালবাসা প্রার্থনার মতো  পবিত্র। আর প্রার্থনা কবিতার মতো ছন্দময়। একবার
গভীরে গেলে আরও গভীরে যাওয়ার আকুতি শেষ করে দেয় পার্থিবতা। বাকি সব জীবন্ত হয়ে উঠে প্রকৃতির কোণে নিভৃত আলস্যে গেয়ে চলা চড়ুই পাখির মোহন আনন্দে।কবিতাকে তিনি তুলে এনেছেন মনের জটিল আঙ্গিনা  হতে সাধারণ পাঠকের মাঝে চড়ুই পাখির মতো স্বাভাবিকতায়। এ ভাষা শুধু সহজ নয়, সরলও বটে। এটি শামসুল আলম সেলিমের কবিতার আর একটি বিমূর্ত দিক, কত কঠিন বিষয়কে কত সহজে ফুটিয়ে তুলতে পারেন তিনি  :
“উপলব্ধি এবং বিশ্বাসের মূল্য কত
’ভালোবাসি’শব্দটিও আমার কাছে প্রার্থনার মত।” (ভালবাসা প্রার্থনার মত)।

কথা সাহিত্যেও তিনি কথার মতো উদ্দাম, বর্ণনার মতো চঞ্চল। তার স্ট্যাটাসে এর প্রমাণ মেলে। বক্তৃতায় পাওয়া যায় তার ছাপ। ছোট ছোট বাক্যগুলো নিপুন বিন্যাসে বিন্যস্ত। প্রতিটা লেখা, প্রতিটা লাইন এমন দৃপ্ত এবং দীপ্ত যে, একটা শব্দও এদিক ওদিক হলে যেন প্রলয় ঘটে যাবে লেখায়। আমরা তাঁর কাছ হতে এমন প্রলয় চাই। শামসুল আলম সেলিম শুধু কবিতা নয়, কবিতার তৃপ্তি, এবং আধুনিকতার সারল্যে জটিল জীবনের সহজ বিছানা। তিনি রুদ্রতার ভোর কিংবা ভালবাসার প্রলয়- সবকিছু উপেক্ষা করে যে কোনো পরিস্থিতিতে কবিতার মতো উচ্ছ্বাসে থাকতে চান :
এতো বাগবিতন্ডা,যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা!
কি পেলে অবশেষে? কেবল পোড়া মাটি-পোড়া ছাই?
চলো না তার চেয়ে দু'দন্ড ভালোবাসার কথা বলি ..।

1 comment:

  1. বুঝি না, রবীন্দ্রনাথ কী ভেবে যে বাংলাদেশে ফের
    বৃক্ষ হয়ে জন্মাবার অসম্ভব বসনা রাখতেন ।
    গাছ নেই নদী নেই অপুস্পক সময় বইছে
    পুনর্জন্ম নেই আর, জন্মের বিরুদ্ধে সবাই

    শুনুন রবীন্দ্রনাথ, আপনার সমস্ত কবিতা
    আমি যদি পুঁতে রেখে দিনরাত পানি ঢালতে থাকি
    নিশ্চিত বিশ্বাস এই, একটিও উদ্ভিদ হবে না
    আপনার বাংলাদেশ এ রকম নিস্ফলা, ঠাকুর
    Visit to read full poem

    ReplyDelete