Thursday 7 July 2016

প্রমিত বাংলা ব্যাকরণ ও নির্মিতি : অসাধারণ একটি ব্যাকরণ / মিনহা ছিদ্দিকা

প্রমিত বাংলা ব্যাকরণ ও নির্মিতি : অসাধারণ একটি বাংলা ব্যাকরণ 

পুথিনিলয়, বাংলাবাজার, ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘প্রমিত বাংলাব্যাকরণ ও নির্মিতি’ একটি অসাধারণ ব্যাকরণ। ড. হায়াৎ মামুদ
ড. হায়াৎ মামুদ ও ড. মোহাম্মদ আমীন
ও ড. মোহাম্মদ আমীন-লিখিত এ গ্রন্থটি শুদ্ধ ও প্রমিত বাংলা শেখায় আগ্রহীদের জন্য হতে পারে একটি অনবদ্য সংগ্রহ।
বাজারে বেশ কয়েকটি ব্যাকরণগ্রন্থ রয়েছে। তা হলে আর একটি ব্যাকরণগ্রন্থের প্রয়োজন কী? এ প্রশ্নের উত্তর হায়াৎ মামুদ বলেন, প্রয়োজন রয়েছে এবং এ প্রয়োজনীয়তার অনিবার্যতাকে পূর্ণ করার জন্য বাংলা ভাষার একজন শিক্ষক ও বাংলাভাষী হিসাবে মাতৃভাষার প্রতি দায়বদ্ধতার অনুভূতি থেকে ‘প্রমিত বাংলা ব্যাকরণ’ গ্রন্থটি রচনা করি। ভাষা বহমান নদীর মতো গতিময় ও চঞ্চল।  নদীর প্রবাহ-ভিত মাটি কিন্তু ভাষার প্রবাহ-ভিত ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী। এটি
 ব্যাকরণটি নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে লেখক ড. মোহামম্মদ আমীন ও হায়াৎ মামুদের ভাষ্য অভিন্ন । তাঁদের মতে, বাংলা বাংলা ভাষার সূচনালগ্ন হতে নানা কারণে বিভিন্নভাবে এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে বাংলা একাডেমির সিদ্ধান্তে ২০১৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রমিত বানান রীতির প্রবর্তনসহ বাংলা ভাষা বা বাংলা বানানে যে পরিবর্তন, সংশোধন, সংস্কার বা বিচরণগত পরিবর্তন হয়েছে তা আলোচ্য ব্যাকরণগ্রন্থে তুলে ধরা হয়েছে। মাতৃভাষার প্রতি দায়শোধের ইচ্ছায় পরিণত বয়সে, তিনি এ গ্রন্থের জন্য যে সময় ও শ্রম দিয়েছি, তা ইতোপূর্বে আর কোনো গ্রন্থের জন্য দেননি। এভাবে বিরামহীন সময় দিয়ে লেখা এটি তার প্রথম ব্যাকরণগ্রন্থ। বাংলা একাডেমি ২০১৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলা বানান ও ভাষা-রীতিতে যে পরিবর্তন বা সংস্কার করেছে- সেসব বিষয় এ গ্রন্থে উপস্থাপিত হয়েছে। এরূপ হালনাগাদ কোনো গ্রন্থ বাজারে নেই।
একাডেমি বাংলা ভাষার অবিভাবক। প্রমিত বানান, ভাষার নিয়মনীতি ও বানান বিষয়ক নানা শৃঙ্খলা নির্ধারণ এবং সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয়তার দিকে লক্ষ রেখে যথাসময়ে ভাষারূপ নদীর সুচারু নিয়ম-নীতি নির্ধারণ এর অন্যতম দায়িত্ব। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পরিবর্তনের দিকে লক্ষ রেখে স্বল্পসময়ের মাঝে ওই পরিবর্তনকে প্রতিভাত করে
ব্যাকরণগ্রন্থ রচনা এবং তা সর্বস্তরের জগণের কাছে সহজলভ্য করে তোলার ঐকান্তিক প্রয়াস লক্ষণীয়। আমাদের দেশে পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রত্যাশিত সময়ে মধ্যে নতুন ভাষারীতি সৃজনের ধারাবাহিকতায় ঘাটতি দেখা যায়। রীতি প্রণীত হলেও যথাযথ প্রচার এবং সর্বসাধারণের নিকট সহজলভ্য করে তোলার ব্যবস্থা বেশ দুর্বল। সংগত কারণে হালনাগাদ ভাষারীতি ও প্রমিত বানান সম্পর্কিত পরিবর্তন খুব ক্ষুদ্র একটি জনগোষ্ঠী ছাড়া প্রায় সবার কাছে অজানা থেকে যায়। এজন্য প্রমিত ও শুদ্ধ বাংলা বানানে চলবে নৈরা্জ্য ও প্রচণ্ড স্বেচ্ছাচারিতা। এমনকি শিক্ষার্থিদের জন্য লিখিত ব্যাকরণগ্রন্থসমূহেও প্রমিত বানান সম্পর্কে বাংলা একাডেমির হালনাগাদ পরিবর্তনের যথার্থ্য প্রতিফলন দেখা যায় না। তাই অধিকাংশ বাংলাভাষীর কাছে প্রমিত বানান ও হালনাগাদ ভাষারীতি অজানাই থেকে যায়। এ বিষয়ে বৈয়াকরণ বা পণ্ডিত ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা কর্তৃপক্ষের ভূমিকাও নানা কারণে পর্যাপ্ত বলে মনে হয় না। বাংলা একাডেমি ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলা বানান রীতির যে পরিবর্তন করেছে, তা এখনও সিংহভাগ শিক্ষার্থী এমনকি অধিকাংশ শিক্ষকেরও অজানা। এসব বিবেচনায় বাংলাভাষার সাম্প্রতিক পরিবর্তনসহ ভাষার হালনাগাদ অবস্থান-প্রকৃতির নানাদিক বিশ্লেষণ করে হালনাগদ প্রমিত বানানকে সহজলভ্য করে তোলা এবং ছাত্রছাত্রীদের এ বিষয়ে অবগত করানোর লক্ষ্যে ‘প্রমিত ব্যাকরণ ও নির্মিতি’ গ্রন্থটি রচনা করা হয়। ড. হায়াৎ মামুদ বইটি লেখার বিষয় জানালেন, “এভাবে শ্রম দিয়ে রচিত আমার এ প্রথম ব্যাকরণ গ্রন্থ। তিনি  আশা করেন, তার মৃত্যুর পরও  সহলেখক ড. মোহাম্মদ আমীন যথাপ্রয়োজনে ও যথাসময়ে ধারাবাহিক সংস্কারের মাধ্যমে আমাকে মাতৃভাষায় বাঁচিয়ে রাখবেন।
মানুষের আচার-আচরণ, আর্থসামাজিক অবস্থা, রাজনীতি, ব্যক্তিগত দর্শন এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোসহ অসংখ্য উপাদানের মাঝ দিয়ে ভাষাভাষীর প্রাত্যহিক যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম হিসাবে নদীর মতো অবিরত ধেয়ে চলে। নদীর মতো ধেয়ে চলা ভাষার চলার পথে সৃষ্টি হয় নতুন শব্দ, ধ্বংস হয়ে যায় অনেক পুরানো চিহ্ন-বর্ণ-শব্দ, প্রাচীন রীতির বুক চিরে সৃষ্টি হয় নতুন রীতি; শব্দের পলিতে জেগে ওঠে অসংখ্য নতুন ভাষাচর। এসব ভাষাচরের উপর বিস্তৃত হয় নিবিড় অরণ্যের মতো রহস্যময় সম্পদে ঋদ্ধ অসীম সাহিত্যনগর- ছন্দোময় কবিতা, রূপময় গল্প, বিদগ্ধ বাণী, হৃদয়কাড়া গান আর প্রাণমগ্ন প্রকাশ। ভাষানদীর প্রবাহ এবং সৃষ্টির এ বহুমুখী দ্যোতনার বিশাল জগত অসংখ্য উপাদানের ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়ায় অবারিতভাবে ধাবিত হয়। এজন্য নদীর মতো ভাষাও কিছুটা স্বেচ্ছাচারী, কিছুটা অনিশ্চিত, কিছুটা দুরন্ত এবং প্রায় পুরোটাই প্রকৃতির মতো উচ্ছ্বল। প্রতিনিয়ত পরিবর্তন ঘটছে ভাষার এবং তার প্রবাহ পথের। তাই এ স্বেচ্ছাচার, অনিশ্চিয়তা, দুরন্ত আর উচ্ছলতাকে স্নেহাবেশে সমন্বিত করে প্রাত্যহিক যোগাযোগের কাজে বাঙ্ময় প্রগাঢ়তার সুচারু সৌন্দর্যে মার্জিত রাখার জন্য নিত্য কিছু নিয়মনীতি প্রয়োজন হয়। যা ব্যাকরণ নামে পরিচিত। এ নিয়মনীতি নদীরূপ
লেখকদ্বয়ের সঙ্গে প্রকাশক শ্যামল পাল
ভাষাকে শাসন করার জন্য নয় বরং ভাষার আশ্রয় তথা মানুষের আচরণকে এমনভাবে সুসংহত করে তোলা, যাতে ভাষানদী তার মোহনীয় গতির বৈচিত্র্যময় ঐশ্বর্যে সাবলীল গতিতে এগিয়ে যেতে পারে কোনোরূপ বিঘ্ন ছাড়া। অধিকন্তু সুশৃঙ্খল আবেশে সর্বজনীন বোধগম্যতা আরও বৈচিত্র্যময় করে তোলার জন্যও ভাষার পরিবর্তনের দিকে লক্ষ্য রেখে স্বল্পসময়ের ব্যবধানে কিছু নিয়মনীতি বা শৃঙ্খলাসূত্র বেঁধে দিতে হয়। এ নিয়মনীতি ভাষাকে করে সুশৃঙ্খল, তার গতিকে করে অর্থবহ এবং বোধগম্যতাকে করে তোলে সর্বজনীন। আলোচ্য গ্রন্থে  মূলত এটাই প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হয়েছে।
ড. হায়াৎ মামুদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ও বাংলা বানান-বিশেষজ্ঞ ড. মোহাম্মদ আমীনের মেধায় প্রথম বারের মতো রচিত এ ব্যাকরণ গ্রন্থটি রচনায় প্রমিত বাংলা বানান বিশেষজ্ঞ, বাংলা বানান নিয়ে একাধিক গ্রন্থের রচয়িতা ও শুদ্ধ বানান চর্চা
গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ড. মোহাম্মদ আমীন যে শ্রম ও মেধা দিয়েছেন তা তিনি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেন।গ্রন্থটি বাংলা শেখায় আগ্রহী যে কোনো ব্যক্তির সংগ্রহে রাখা ও থাকা উচিত। এটি শুধু ছাত্রছাত্রীদের জন্য নয়, বরং যে কোনো ব্যক্তি ও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদেরও উপযোগী একটি অনবদ্য ব্যাকরণ। আমরা বইটির বহুল প্রচার কামনা

Wednesday 1 June 2016

পূর্ণা রায় : ভালবাসার প্রৈতি, মুগ্ধতার প্রীতি / ড. মোহাম্মদ আমীন


কবিতা কী?
প্রীতির বিভরে প্রেমের উচ্ছ্বাস
আর?
দ্রোহের আগুনে নিদাঘ নির্যাস।
প্রকৃতপক্ষে কবিতা একটি শক্তি, শক্তির অনুমন। কবিতা তার শব্দের শক্তি নিয়ে নদীর গতিতে সমুদ্র বানায় মরুভূমির বুকে, সবুজের মেলায় ভরিয়ে দেয় অনুর্বর মাটির চৌচির বক্ষ। প্রেম আর সখ্যের নিপূন বক্ষে কবিতা এঁকে দেয় রঙের দ্যোতনা। কবি পূর্ণা রায়ের কাব্য ‘প্রৈতি’ পড়ে আমার এমনটিই মনে হয়েছে। তার কাব্যশক্তির নিস্তব্ধ প্রতীমা শব্দের প্রবল শক্তিতে যখন বিভোর হয়ে ওঠে, তখনই গতি পায় হৃদয়, উথলে ওঠে বিগলিত মাধুর্যের নিটোল সুন্দর আর হাতের দিকে ছুটে আসে কলম, মনে ভিড় জমায় ছন্দ। অবকাশে কবি পূর্ণা রায় ভালবাসার মমতায় সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব উড়িয়ে শান্তির বিহব্বল অবকাশে উদাস হয়ে যেতে চান প্রকৃতির মধুর অভিলাষে কবিতার খাতায়। এখানে বিভেদের সব রেখা নিশ্চিহ্ন, জীবন শুধু মমতার শিকড়ে খুঁজে বেড়ায় রস। কবির ভাষায় :
“ভয় পেয়ো না প্রিয় ...
আমাদের আলিঙ্গনে হবে
সুবাতাসের চাষ।” [পূর্ণা রায়, এমন সাধ্য কার, প্রৈতি]

পূর্ণা রায় অনুভূতিতে সরব, সুভাষে তার মুখরতাগুলো কাব্যিক ছন্দের নির্বাক হিল্লোল তুলে আগামীর, আগমন আর প্রত্যাশার। মানুষকে জানার, জানবার এবং কাছে টানার অনবদ্য এক অভিলাষ তাকে বিভোর করে তোলে কবিতার মতো প্রমুগ্ধ প্রগলভতায়। প্রেমের মতো প্রকৃতিও তার কাব্যের মসলা, জীবনবোধে উদ্বুদ্ধ পূর্ণা রায়ের প্রীতিময় সোহাগ শিলং পাহাড়ের সুদূর কোণায় মেঘদূত হয়ে ছোট হৃদয়েও ভীষণ ঢেউ তোলে। তিনি তখন আনমনা হয়ে যান নিরুদ্বেগ ভাবুলতায়, চোখ বন্ধ করে অদৃশ্য দর্শনে নেচে ওঠেন নৃত্যের গর্জনে মেঘের কুহুরে। সীমাহীন সীমায় ফেনিল রাশির ন্যায় রাশি রাশি অণু, তার অনুভবের দ্বারে দ্বার নাড়ে। তখন হৃদ্যতার আকণ্ঠে ডুবিয়ে দিতে চান তিনি তার কবিতার সব মেঘমালা :
“কেমন আছো অমিত রয়?
পোকা কাটা
হলদে কাগজ থেকে বেরিয়ে এসো
প্রকট হও
শিলং পাহাড়ে মেঘদূত জমবে আজ
প্রলাপে মেতেছে তোমার ঘন ঘোর বরষা” [ পূর্ণা রায়, কেমন আছো?, প্রৈতি]

পূর্ণা রায় ‘প্রৈতি’র সাঝে এবং সাজের ভাঁজে শুকিয়ে যাওয়া রূদ্রাক্ষের মালাতেও সজীবতার ছোঁয়ায় শিউরে ওঠেন রমণীয় প্রকৃষ্টতায়। ভালবাসা তার নদীর মতো। যে নদী জলম্বুর, জলে জলে জলময় কেবল সে নদীই জলধি হতে পারে; জলময় উর্বরতায় ভরিয়ে দিতে পারে চারিপাশ পলির চুমোয়। তাই যার মধ্যে ভালবাসা আছে কেবল সে- ভালবাসার
জন্য জীবন দিতে পারে। ভালবাসা কবির মতো নিস্পৃহ কিন্তু বাতাসের মতো অনিবার্য আর জলের মতো পরম। ‘প্রৈতি’ কাব্যের ‘ভালবাসা’ শিরোনামের কবিতায় কবি পূর্ণা রায় ভালবাসার যে সংজ্ঞার্থ এবং ক্রিয়াপ্রকরণ বিধৃত করেছেন তা জীবনের চেয়েও অমোঘ, মৃত্যুর চেয়েও কঠিন। প্রাত্যহিক জীবনের নানা টানাফোড়েনের টানে টানে ভালবাসার রূপ কীভাবে বদলায়, কীভাবে ভালবাসা আকাশের মতো নানা বৈচিত্র্যময় ঢঙে পরম কাছের হয়েও চরম দূরের হয়ে যায় Ñ তা হতভম্ব করে দেওয়ার মতো উপমায় বর্ণনা করা হয়েছে কবিতায়। মানুষের সম্পর্কের নানা সাংঘর্ষিক দিকের বর্ণনা দিতে গিয়ে কবি তার কবিতায় বাগানের মতো রঙীন ক্ষেত্রে মালির প্রয়াসে গড়ে তুলেছেন অনবদ্য এক শব্দ বাগান :
“ভালবাসার অনেক ডালপালা হয়
উড়াল ডানা হয়, শেকড়-বাকড় হয়
অনেক লম্বা হাত হয়, দানবের দাঁতের মতো
শক্ত দাঁত হয়; নখরও হয়
ভালবাসা বাতাসে ওড়ে;
ক্লান্ত শরীর টেনে কখনও একটু জিরোয়” [পূর্ণা রায়, ভালবাসা, প্রৈতি]

মানবতায় আপ্লুত কবির হৃদয় ভালবাসার সাম্যে কানায় কানায় পূর্ণ হলেও মাঝে মাঝে কিছু ক্ষোভ তার কাব্যে
লবণের মতো লাবণ্যময় দ্যোতনা টেনে দেয়। যা তার কবিতাকে করে তুলে আরও হৃদয়গ্রাহী আরও জীবনমুখী এবং বাঙ্ময়। দুঃখ আছে বলেই সুখের আকাঙ্ক্ষা এত তীব্র, অশান্তি আছে বলেই শান্তি এত মিষ্ট। ভালবাসা দিয়ে সব জয় করা যায়। তাই ভালবাসার জন্য তিনি জীবন দিতে পারেন। শুধু পার্থিব প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা মানুষকে পশু করে দেয়, এটি জীবন নয়; পচনশীল লাশের বিরক্তিকর অনুভূতি। তাই কবি পূর্ণা রায় শুধু পার্থিব প্রাপ্তি নয়, হৃদ্যিক মননশীলতা দিয়ে পার্থিব বিষয়কে উপস্থাপন করেন সর্বজনীন সাদরে :
“আজ বাতাসের আনাগোনা অন্যরকম,
অন্য সুরের আভাস ছিল
                              তোমার গোপন চলা নদীর চরে” [পূর্ণা রায়, অন্যরকম বাতাস, প্রৈতি]

শব্দচয়নে কবি বেশ আবেগময়। তবে আবেগের মাঝেও তার রয়েছে পূর্ণ সচেতনতা এবং সজাগ মাদকতা। যার চারিপাশ ঘিরে রূপোলি বিকেলগুলো তার ভোরের শিশির-স্নাত ঘাসে সবুজের মায়ায় অন্যরকম আবেশ টেনে দেয় প্রাণে। যতই কিছু হোক, যাই ঘটুক তিনি প্রবল আত্মবিশ্বাসে অনুসময় হিমেল হিমালয় :
“নিঃসঙ্গ রাত, কালো অন্ধকার যাচে- স্থবিরতা
হুঁতোমপেঁচাকে বলে; চোখটা তোর বন্ধ রাখ” [পূর্ণা রায়, অন্ধকারের গ্রাসে, প্রৈতি]

কবিতা মানুষের মনের প্রকাশ, প্রকৃতি তার সহায়ক উপলব্ধি। বস্তুত এ দুটি ঘিরে পরিবেশ-প্রতিবেশ। তাই কবি, কবিতা এবং জীবন ও প্রকৃতির মধ্যে মূলত কোন তফাত নেই। সবার মিলনই কবিতা এবং কবিতাই জীবন। কবি পূর্ণা রায় তার কাব্যে এটিই দেখিয়েছেন, শব্দের গোছায় ছন্দ লাগিয়ে দারুণ এক মমতায় :
“তুমি বৃষ্টি হয়ে ঝরবে তাই
চুল গেছে খুলে” [পূর্ণা রায়, কতদিন পর, প্রৈতি]

উপমা কবিতার অলঙ্কার। কবিরা শব্দের বন্যায় বাক্যের বাঁকে বাঁকে উপমা বসিয়ে একটি সাধারণ বিষয়কেও অসাধারণ করে তুলতে পারে। উপমা যত সুন্দর হয়, যত আলোময় হয়, যত নিকষ হয়-
কবিতার রস তত লাস্যময় হয়ে ওঠে। এ উপমা মানুষের অনুভূতিকে জীবনের স্তরে স্তরে রক্তের মতো ছড়িয়ে দিয়ে দূষিত জিনিসগুলো নিয়ে আসে। কবিতায় উপমা প্রয়োগে কবি পূর্ণা রায় যেমন বিচক্ষণ তেমন বিলাসী আবার রসময় সচেতন। কোথায় কখন কোন উপমা আনতে হবে সে বোধ তার কবিতার একটি অনবদ্য অলঙ্কার। এ অলঙ্কার পূর্ণার কবিতাকে প্রথম প্রেমেপড়া কিশোর-কিশোরীর মতো আবেশিত করে রাখে ঘন নিঃশ্বাসের অতুল কাব্যবক্ষে :
“কাল বিকেলে
আমার সদ্য ফোটা স্বপ্নগুলো
যখন তোমার হাতে গুঁজে দিলাম
এক-আধটু ভেজা ছিল,
তুলতুলে ওই স্বপ্নগুলো
কেমন আছে?” [পূর্ণা রায়, জানতে দিও, প্রৈতি]

গতকালই পেয়েছি পূর্ণা রায়ের কাব্যটি। খামে আপেলের মতো নির্ঝর শব্দে লেখা ঠিকানাগুলোই বলে
দিচ্ছিল কবি সুন্দরের খুব নিকটে সুন্দরেই লালিত। তাই  সৌন্দর্যবোধ তাকে অবিরাম গুছিয়ে রাখে। তার কবিতার শব্দচয়ন কৌশলেও এমনটি দেখলাম। প্রচ্ছদটাও হয়েছে অসাধারণ, দেখামাত্র বোধের উন্মেষ ঘটায় পলকে পলকে পত পত জ্যোছনায়। তবে কিছু মুদ্রণ প্রমাদ আছে, অবশ্য বাংলা ভাষায় মুদ্রণ-প্রমাদহীন কোনো গ্রন্থ আমার চোখে পড়েনি। যাই হোক, চৌষট্টি পৃষ্ঠার ‘প্রৈতি’র চৌষট্টি কবিতা যেন চৌষট্টি শতকের ভাবনার অনিমেষ সারবিন্দু। যার পরতে পরতে শিহরণের উষ্ণ শ্বাস। পড়তে পড়তে একসময় শেষ হয়ে গেল। ইস্‌ আরও কয়েকটি যদি থাকত! তাহলে আরও ভালবাসা নেয়া যেত, কিন্তু তা কী হয়! পূর্ণা রায়ের মনোহর ভাষায় বলা যায় :
“ঝাপসা চোখে তৃষ্ণা মেটানো যায়,
ভালবাসাকে ভালবাসা যায়- ছোঁয়া যায় না” [ভালবাসাকে ছোঁয়া যায় না, প্রৈতি]

পূর্ণা রায়  “প্রৈতি”র উপহারে পূর্ণ প্রীতিতে ভরিয়ে দিয়েছে আমার মন। ভালবাসার মননশীলতায় বিভোর কবি পূর্ণার কাব্যকন্যা “প্রৈতি” আমাকে অনেক আনন্দ দিয়েছে, অনুভবের খোড়াক দিয়েছে। পূর্ণার প্রতি রইল অনেক অনেক ভালবাসা। কারণ :
“ভালবাসতে জানে যে-
তাকে ভালবাসতেই হয়।” [পূর্ণা রায়, ভালবাসা, প্রৈতি]

আমার প্রত্যাশা, আরও এগিয়ে যাক পূর্ণা রায়
ভালবাসার কবিতায়
আমাদের সবার মাঝে
সারাক্ষণ, রাতে, সন্ধ্যায় এবং সাঝের সাজে।