Friday 22 December 2017

মেয়ে গৃহকর্মী ওসি এবং স্ত্রী রিভিউ / শ্রাবন্তনাহা অথৈ

মেয়ে গৃহকর্মী ওসি এবং স্ত্রী  ড. মোহাম্মদ আমীনের লেখা ভালোবাসা শুধুই ভালোবাসা গল্পগ্রন্থের একটি গল্প। গল্প কতো জীবন্ত, বাস্তব
এবং হৃদয়গ্রাহী হতে পারে তা এই গ্রন্থটি না পড়লে বোঝা যাবে না। সৌভাগ্যবশত আমি এই গল্পগ্রন্থের পাণ্ডুলিপিটা একবার পড়ার সুযোগ পেয়েছি। এজন্য প্রমিতার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। কোনো  লেখকের বই প্রকাশের আগে পাণ্ডুলিপি ছুঁয়ে দেখতে পারা এবং লেখকের কাছ থেকে পাওয়া পাণ্ডুলিপি পড়তে পারার বিরল অনুভূতির সঙ্গে যদি বইয়ের অসাধারণত্ব যুক্ত হয় তাহলে সেটি জীবনের অবিস্মরণীয় ঘটনা হয়ে ওঠে। আমি এমন অবিস্মরণীয় ঘটনার স্বাদ পেয়েছি।
ভালোবাসা শুধুই ভালোবা গল্পের প্রত্যেকটি গল্প ইতিহাসের মতো জীবন্ত। লেখকের জীবনের বাস্তব ঘটনা নিয়ে অনবদ্য সাহিত্যমগ্ন উপস্থাপনা পাঠকে শুধু আনন্দই দেবে না, লেখকের সঙ্গে একীভূত করে দেবে জীবনের চাওয়াপাওয়া, টানাপোড়েন আর হাসি-কান্নার আনন্দবিধুর সমাসন্নতায়। এমন বই আমি পড়িনি। এটি আমার কোনো বাহুল্যাক্তি নয়, অনুভবের নিবিড় অভিজ্ঞতা। মানুষকে মননশীল হতে হলে সাহিত্যকর্ম অধ্যয়ন কত আবশ্যক তা এই গ্রন্থটি পড়লে বুঝতে পারবেন।
বইটির প্রকাশক পুথিনিলয়, প্রচ্ছদ করেছেন মামুন হোসাইন, দাম ১২০ টাকা। বইটি আগামী অমর একুশে গ্রন্থমেলার (২০১৮) পুথিনিলয়ের স্টল থেকে সংগ্রহ করে নিতে পারেন। এখানে গল্পগ্রন্থটির একটি গল্প দেওয়া হলো। এটি লেখক তার ফেসবুকে প্রচার করেছেন। আশা করি ভালো লাগবে। আমি নিঃসন্দেহে বলতে পারি, এই বইটি আপনার সংগ্রহশালাকে সমৃদ্ধ করবে। আপনাকে করবে আনন্দ আর প্রত্যয়দৃষ্টে নির্ভরশীল ও সাহসী। তাহলে পড়ে দেখি গল্পটি :

মেয়ে গৃহকর্মী ওসি এবং স্ত্রী  রিভিউ


২০০১ খ্রিষ্টাব্দের কথা।
আমি তখন যশোর জেলার অভয়নগর উপজেলার ইউএনও।ইউএনও হিসেবে এটি আমর দ্বিতীয় পদায়ন। এর আগে ছিলাম শরীয়তপুর জেলার ভেদরগঞ্জের ইউএনও।
সৌজন্য সাক্ষাতে এসেছেন অভয়নগর থানায় সদস্য যোগ-দেওয়া ওসি। সঙ্গে সেকেন্ড অফিসার। পিয়ন মালেক তাদের ড্রয়িং রুমে
ড. মোহাম্মদ আমীন
বসতে দিলেন। আমি তখন দোতালায় ঘুমোচ্ছিলাম।
ওসি মানে অফিসার ইনচার্জ। মর্যাদায় পুলিশ পরিদর্শক।উপজেলার জবরদস্ত অফিসার। তাকে খাতির করেন না এমন অফিসার নেই। শুধু অফিসার কেন, রাজনীতিক নেতারাও খাতির করেন। উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে খাতির না-করলেও চলে কিন্তু ওসিকে খাতির না-করে উপায় নেই। যার লাঠি তার মাটি। লাঠির জন্ম হয়েছে মাটি দখলের জন্য।
ওসি সাহেব ড্রয়িং রুমে বসে আমার জন্য অপেক্ষা করছেন।বারান্দায় একজন মেয়ে হাঁটছে।ওসি সাহেব মেয়েটিকে বললেন : মা একটু এদিকে এস তো।
এগিয়ে আসে মেয়েটি : কিছু বলবেন?
: এক গ্লাস পানি দাও। 
মেয়েটির ইশারা পেয়ে পিয়ন মালেক এক গ্লাস পানি দিয়ে গেলেন। 
ওসি সাহেব, দারোগাকে বললেন : ইউএনও স্যারের মেয়েটি বেশ সুন্দর। 
আরও কিছুক্ষণ কেটে যায়।এখন মেয়েটি বারান্দায় কাপড় নাড়ছে। ঘড়ি দেখলেন ওসি সাহেব। অফিসে অনেক কাজ। তাড়াতাড়ি যেতে হবে।
মেয়েটিকে আবার ডাক দিলেন ওসি সাহেব : মা, তোমার আব্বুকে আমার খবর দিয়েছ?
মেয়েটি কিছু না বলে উপরে চলে যায়। ওসি সাহেবের আগমনবার্তা জানার কয়েক মিনিট পর নিচে নামলাম।
সালাম দিয়ে হ্যান্ডসেকের জন্য হাতি বাড়িয়ে দিলেন ওসি সাহেব। 
দুজন উপজেলার হর্তা-কর্তা।ওসির হাতে লাঠি, আমার হাতে তাজ। তবে লাঠির ক্ষমতা তাজের চেয়ে বেশি। দুজনের বনিবনা না হলে উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে অপদস্থ হতে হয়। তাজ দিয়ে কাউকে পেটানো যায় না। কিন্তু লাঠি দিয়ে তাজ কেন, মাথা পর্যন্ত ফাটিয়ে দেওয়া যায়। তাই সর্বত্র লাঠির জয়। 
হ্যান্ডস্যাকের পর শুরু হলো গল্প- চাকরি, দেশ, উপজেলা- - - সংসার
ওসি সাহেব বললেন : আপনার মেয়েটি কোন ক্লাশে পড়ে স্যার? 
: আমার মেয়ে স্কুলে পড়ে না। ছয় মাস বয়স। একমাত্র ছেলে ক্লাস ফোরে পড়ে।
: বারান্দায় একটা মেয়েকে দেখলাম, কাপড় নাড়ছে। সে কে?
আমি বললাম : গৃহকর্মী। শিশুবেলা থেকে আমাদে বাসায়। খুব ভালো মেয়ে।
একটু লজ্জা পেয়ে গেলেন জামাল সাহেব। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আবার স্বাভাবিক হয়ে যান। কাজের মেয়েকে নিজের মেয়ের মতো এমন সাজিয়ে গুছিয়ে রাখলে যে কেউ এমন ভুল করতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা, গৃহকর্মী কীভাবে এত সুন্দর হয়! অত চিন্তা করে লাভ নেই, বড় অফিসার, বড় কাজকারবার- ওসি সাহেব মনে মনে ভাবলেন। 
দারোগা ফিস ফিস করে বললেন : আজকাল অনেক বাসায় এমন দেখা যায়। এটা একটা ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কলিকালে আরও কত কী দেখা যাবে!
কিছুক্ষণ পর বারান্দার মেয়েটি ড্রয়িং রুমে ঢুকল। ওসি সাহেব মেয়েটিকে দেখে বললেন : স্যার, আমি কিন্তু এ মেয়েটিকে আপনার মেয়ে মনে করেছিলাম।তাকে দেখে কাজের মেয়ে মনে হয়নি। কাজের মেয়েকে নিজের মেয়ের মতো যত্নে রেখেছেন। খুব ভালো লাগল। 
কিছুক্ষণ চুপ থেকে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে ওসি সাহেব বললেন : এ মেয়ে তুই আমার জন্য আর এক গ্লাস জল নিয়ে আয়। খুব গরম পড়ছে। তেষ্ঠা পাচ্ছে বার বার। তাড়াতাড়ি আসবি।
মেয়েটি না শোনার ভান করে মালেককে পানি আনার ইশারা দিয়ে সোজা আমার গা ঘেঁষে বসে বলল: তুমি চা খাচ্ছো না কেন?
ওসি সাহেব মেয়েটির কাণ্ড দেখে অবাক। পনের-ষোলো বছরের একটা কাজের মেয়ের সাহস দেখে চোখ তার রীতিমতো ছানাবড়া। হায় হায়, এ কী! একজন উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সঙ্গে কাজের বুয়ার এমন ঢলাঢলি, তা-ও আবার ওসির সামনে, ছি! কী অনাচার!
চায়ের কাপ হাতে নিতে নিতে আমার পাশে বসা মেয়েটিকে দেখিয়ে বললাম : ওসি, সাহেব ইনি আমার স্ত্রী।
জামাল সাহেবে যেন আকাশ থেকে পড়লেন। লজ্জায় তার ফর্সা আর নাদুস-নুদুস পুলিশি চেহারাটা ফ্যাকাশে। জগ থেকে গ্লাসে গলগল করে পানি ঢেলে বললেন : কী বললেন স্যার?
: আমার স্ত্রী।
ওসি সাহেব অনেক কষ্টে ডান হাতটা কপালে তুলে আমার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন : আসসালামুআলাইকুম।
----------------------------------------------------
সূত্র : ড. মোহাম্মদ আমীন, ভালোবাসা শুধুই ভালোবাসা গল্পগ্রন্থের একটি গল্প।
প্রকাশক : পুথিনিলয়। প্রচ্ছদ : মামুন হোসাইন
প্রাপ্তিস্থান : পুথিনিলয় স্টল, অমর একুশে গ্রন্থমেলা/২০১৮।

Wednesday 20 December 2017

ভালোবাসা শুধুই ভালোবাসা / প্রমিত দাস লাবণী

ভালোবাসা শুধুই ভালোবাসা

ড. মোহাম্মদ আমীনের লেখা একটি গল্পগ্রন্থ। গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার আগে এর তিনটি গল্পে ফেসবুকে প্রকাশিত হয়। তিনটি গল্পই ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে যায়। স্যার আমাকে বিয়ে করুন নামের গল্পটি দিয়ে অনেক চ্যানেল ভিডিও পর্যন্ত তৈরি করে। অর্থনীতির অধ্যাপক সেলসম্যান এবং বউ’ শিরোনামের গল্পটি ফেসবুকে প্রকাশিত হওয়ার বোদ্ধামহলে সাড়া পড়ে যায়। বিদেশি নাম দেখে অনেকের মনে হতে পারে এটি কোনো গল্পের বঙ্গানুবাদ। লেখকের ভাষায়, “এটি কোনো অনুবাদ নয়, আমেরিকায় থাকাকালীন বেস্ট বাই চেইন শপে বাজার করতে গিয়ে গল্পটির প্লট আমার মাথায় আসে।” তাই চরিত্রের নাম বিদেশি। নিচে পাঠকদের জন্য গল্পটি লেখকের অনুমতি নিয়ে প্রকাশ করা হলো। অসাধারণ কিছু গল্প নিয়ে সজ্জিত এই বইটি পড়লে আপনার এবং আপনার উত্তরসুরী- সবার বিবেক আনন্দ আর ঔদার্যে বিকশিত হয়ে উঠবে।  এটি আমি নিশ্চিত বলতে পারি। এ গ্রন্থের আর একটি গল্পের লিংক দিলাম।(https://www.facebook.com/mohammed.amin.714655/posts/1642520929138028?pnref=story)। বইটি পাবেন আগামী (২০১৮) অমর একুশে গ্রন্থমেলায় পুথিনিলয়-এর স্টলে। দাম মাত্র ১২০ টাকা।  গ্রন্থটির প্রচ্ছদ করেছেন মামুন হোসাইন। 

অর্থনীতির অধ্যাপক সেলসম্যান এবং বউ 

ভদ্রলোক দোকানে ঢুকে সেলসম্যানকে বললেন : প্লাস্টিকের একটা টুল নেব। দুই ডলারের বেশি যেন না
হয়। কোনোভাবে আমি দুই ডলারের বেশি খরচ করব না।
সেলসম্যান বলল : আমার নাম কুপার। আমাদের বেস্ট বাই চেইন শপে পৃথিবীর সবদেশের সব ভালো টুল পাবেন। আরামদায়ক, টেকসই এবং আকর্ষণীয় কিন্তু দাম হাতের নাগালে। তিন ডলার খরচ করলে সেরাটা পেয়ে যাবেন। টুল ছাড়া আর কিছু নেবেন না স্যার?
ক্রেতা বললেন : ধন্যবাদ। আমি মোস আর্নেস। ফিলাডেলফিয়া ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক। চিন্তাভাবনা করে খরচ করি। আমাকে কোনো সেলসম্যান গলাতে পারেনি। আপনিও পারবেন না।
: দেখলেই বোঝা যায় আপনি প্রবল ব্যক্তিত্ববান। অপ্রয়োজনীয় সওদা ভালো নয় স্যার। আমি সেলসম্যান হলেও কখনো ক্রেতাকে অনাবশ্যক কিছু কিনতে উদ্বুদ্ধ করি না। নিজের লাভের জন্য অন্যের ক্ষতি করা অপরাধ।
মিস্টার আর্নেস একটা টুল পছন্দ করলেন। সেলসম্যান টুলটি হাতে নিয়ে বললেন : অপূর্ব। অপূর্ব আপনার পছন্দ। এমন সুন্দর টুল কোথায় ব্যবহার করবেন স্যার?
: লেকের পাশে বসে প্রকৃতি দেখব। প্রকৃতি আমার প্রেম।
: প্রকৃতিকে তারাই এভাবে উপভোগ করেন, যারা প্রকৃতির মতো সুন্দর। কিন্তু স্যার, একটা জিনিস বেশিক্ষণ দেখলে ভালো-লাগাটা কমে যায়। এই ধরুন আমার গার্লফ্রেন্ড, প্রথম প্রথম কী যে ভালো লাগত! কণ্ঠ শুনলেই শরীর রোমাঞ্চিত হয়ে উঠত। এখন গায়ে আছড়ে পড়লেও রোমাঞ্চ আসে না। প্রকৃতির ক্ষেত্রেও এমন ঘটতে পারে।
: কী করতে পারি?
: টুলে বসে মাছ ধরবেন। ফাঁকে ফাঁকে প্রকৃতি দেখবেন। চনাচুর খাবেন, সিগারেট টানবেন, বিয়ার খাবেন, ক্লান্তি এলে বিশ্রাম নেবেন। বিশ্রাম স্বপ্নের বাগান। খুব ভালো লাগবে। কিছু বড়শি দিই স্যার?
: দাও।
বড়শি দিতে দিতে সেলসম্যান বলল : খুব ভালো বড়শি দিলাম। কিন্তু স্যার বড়শি কোথায় বাঁধবেন? আমাদের খুব ভালে সুতো এবং অত্যাধুনিক ছিপ আছে। পছন্দ হবে আপনার। এক সেট দিয়ে দিই?
: দাও।
সেলসম্যান ঝুড়িতে সুতো ও ছিপ রাখতে রাখতে বললেন : অনেকক্ষণ বসে থাকতে হবে। মাংসে ব্যথা হয়ে যেতে পারে। আমাদের দোকানে ভালো কিন্তু সস্তা দামের গদি আছে। বেশ তুলতুলে। আরামের কোনো বিকল্প নেই।
: ঠিক বলেছ। একটা গদি লাগবেই। আমি অফিসের চেয়ারেও গদি ব্যবহার করি।
ধুসর রঙের একটা গদি নামিয়ে সেলসম্যান বলল : স্যার, প্রকৃতি রূপসী মেয়ের মতোই আকর্ষণীয় কিন্তু সেকেন্ডেরও বিশ্বাস নেই। খানিক রোদ, খানিক বৃষ্টি. খানিক ঝড়, খানিক বরফ। হঠাৎ যদি কড়া রোদ উঠে কিংবা ভারী বৃষ্টি হয় তখন কী করবেন?
: তাই তো! কী করব?
: একটা ছাতা এবং একটা সানগ্লাস নিয়ে যান। আমি কী স্যার ভুল বলেছি?
: না। আসলেই প্রয়োজন। দাও এবং কত দাম হলো দেখ। এবার যাব।
: যাবেন স্যার? ছাতার সঙ্গে দুই প্যাকেট চনাচুর, তিন ডজন পানির বোতল, এক ডজন বিয়ার, একটা
ড. মোহাম্মদ আমীন
ফ্লাস্ক, চার সেট কাপ-পিরিস, চারটা চামচ, দুই ব্যাগ চা, আধ কেজি চিনি দিলাম।এগুলি ছাড়া অ্যাংলিং জমে না। আর একটা কথা, এখন না বললে পরে আমার উপর মাইন্ড করবেন। ছোটো টুলটা দিয়ে হবে না। ওটায় চায়ের সরঞ্জাম রাখবেন। আর একটা বড়ো টুল দিলাম। ভারতীয় ঋষির মতো আরাম করে বসতে পারবেন।
: ঠিক আছে। দিয়েছ যখন কী আর করা। তবে অতিরিক্ত কিছু নেব না। আমি অর্থনীতির প্রফেসর।
: স্যার, ধরুন, আপনার বড়শি মাছে টান দিল। বড়ো মাছ। আপনি উত্তেজিত। এসময় হঠাৎ কোনো মশা বা পোকা কামড় দিল, কী হবে? আমি হলে স্যার, একটা ইনসেক্টিসাইড নিতাম।
: সামান্য ইনসেক্টিসাইডের জন্য এত বড়ো মাছটা চলে যাবে। দাও একটা। কিন্তু মাছ বড়ো না ছোটো এটা আমি কীভাবে বুঝব?
: একটা দূরবীন নিয়ে যান। রাতের জন্য টর্চও প্রয়োজন। একটাও অপ্রয়োজনীয় জিনিস নয়। দেব স্যার?
: দাও। আমি অর্থনীতির অধ্যাপক। অপ্রয়োজনীয় কিছু নেব না।
: বৃষ্টি এলে তো ঠান্ডা লেগে যেতে পারে। আমেরিকার বৃষ্টি বাতাস নিয়েই আসে। একটা রেইনকোট গায়ে থাকলে কষ্ট পাবেন না। দেখতেও ভালো দেখাবে। আমাদের সুইস-রেইনকোর্ট আছে। নিয়ে যান স্যার। ভাবীও পছন্দ করবেন।
: দাও। তবে হালকা নীল রঙ। ওই রঙই তোমার ভাবীর পছন্দ।
: অ্যাংলিং খুব টেনশনের বিষয়। শুধু ধূমপান করতে ইচ্ছে করে। সমস্যা সিগারেট নয়, সিগারেটের ছাই। আপনার ব্র্যান্ড?
: বেনসন।
: এক কার্টুন বেনসন, দুটি ম্যাচ এবং একটা অ্যাসট্রে দিলাম স্যার।
: দাও।
: আপনার গাড়িতে কি অ্যাংলিং ক্যাপ আছে?
: নেই।
: ক্যাপ পরে অ্যাংলিং করার মজাই আলাদা। আমি ছুটির দিন গার্ল ফ্রেন্ড অ্যাজারিয়াকে নিয়ে অ্যাঙলিং করি। সে বলে, ক্যাপ ছাড়া নাকি অ্যাংলিং ফুলহীন বাগানের মতো। একটা দিলাম স্যার।
: লাগবে যখন দাও।তবে অতিরিক্ত কিছু নেব না। আমি অর্থনীতির অধ্যাপক।
: আপনি স্যার নিশ্চয় পেনিপেক পার্ক লেকে মাছ ধরবেন, তাই না?
: তুমি কীভাবে জানলে?
: আপনার চেহারা, কথাবার্তা, পেশা আর ব্যক্তিত্ব দেখে মনে হলো এর চেয়ে ভালো লেক ফিলাডেলফিয়ায় থাকলে পেনিলেকেও যেতেন না।
: ঠিক বলেছ। আমি আসলেই সৌখিন।
: অনেক্ষণ মাছ ধরার পর ক্লান্তি আসতে পারে। ক্লান্তি মানে বিশ্রামের আহ্বান। একটা সিংগেল এয়ার মেট্রেস নিয়ে যান। বাতাস ছেড়ে দিলে রুমালের মতো হয়ে যায়। বাসাতেও ব্যবহার করতে পারবেন।
: দাও।
: বিশ্রামে গেলেও স্যার অনেক সময় ঘুম আসে না। আপনাদের মতো বোদ্ধা মানুষের বই ছাড়া ঘুম আসার কথা না। আমার চাচাও অধ্যাপক। তিনি বই ছাড়া বিছানায় যান না। আমাদের দোকানে পৃথিবীর সব দেশের সব ভালো বই আছে। আইজাক ওয়াল্টনের(Izzak Walton) দ্যা কমপ্লেট অ্যাংলার (The Compleat Angler) বইটা নিতে পারেন।
: শুনেছি বইটা ভালো। দাও।বই কখনো অতিরিক্ত হয় না।
: অ্যাংলিং খুব নেশা। ধরুন, আপনার অনেক রাত হয়ে গেল। বাসায় গিয়ে ভাবীকে ডাকলে রাগ করতে পারেন। স্ত্রীদের বিশ্বাস নেই। লেকের পাশে আমাদের একটা হোটেল আছে। খুব ভালো। আপনি ফোন করার সঙ্গে সঙ্গে হোটেলের লোক এসে জামাই আদরে নিয়ে যাবে। একটা রুম বুকিং দিয়ে দিই স্যার?
: দাও।
: সকালে আপনি বাড়ি গেলেন। এতক্ষণ কোথায় ছিলেন কৈফিয়ত চাইতে পারেন ভাবী। মাছ দেখলেও মন গলবে না। বলতে পারেন, মাছ এনেছ মসলাপাতি কই, তেল কই? কিছু মসলা আর ভাবীর জন্য কসমেটিক্স দিই?
: দাও।
: বাচ্চাদের জন্য কী দেব স্যার?
: আমার বাচ্চা নেই।
: তাহলে স্যার বব ডিলনের কয়েকটা ক্যাসেট দিয়ে দিই?
: দাও। তবে অতিরিক্ত কিছু নেব না। আমি অর্থনীতির অধ্যাপক।
: অনেক্ষণ বসে থাকলে কোমড়ে ব্যথা হতে পারে। এক প্যাকেট পেইনকিলার নিয়ে যান। কাজে আসতে পারে। বিপদের বন্ধু।
: দাও।
: বিল কতো হলো?
: দুই হাজার ছয়শ ডলার।
চমকে উঠলেন অধ্যাপক। বিল দিতে যাওয়ার আগে সেলসম্যান কুপার দৌঁড়ে এসে বললেন : বিরাট ভুল হয়ে গেছে। লেন্ডিং নেটস, ক্যাস্ট নেটস, ওজন মাপার স্কেল, ফিশিং রড হোল্ডার, প্লাইয়ারস, গ্রিফার্স, হুক রিমোভার, বাইট এলার্ম, রড কেইস, টিউব, র‌্যাকস এসব নেওয়া হয়নি। এগুলো ছাড়া ফিশিং হয় না। দিয়ে দিচ্ছি স্যার?
: দাও। আমি অর্থনীতির অধ্যাপক। আর কিছু নেব না। মোট কত হলো?
: তিন হাজার পাঁচশ ডলার।
: কিন্তু স্যার আর একটা সমস্যা আছে। এতসব জিনিস দেখলে ভাবী ক্ষেপে যেতে পারেন। তখন কী করবেন?
: তাই তো? কী করব?
: আপনাদের মতো শিক্ষিত লোক বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া করতে পারেন না। কিছু বলতেও পারবেন না, কথাগুলি কানে আসবে বজ্র হয়ে। আমি স্যার, একটা জিনিস দেব। ধরেন, আমার পক্ষ থেকে। ওটি নিলে ভাবীর সব চিৎকার অর্থহীন হয়ে যাবে। দেব স্যার? মাত্র পাঁচ ডলার।
: কী সেটা?
: এয়ার মাস্ক। কানে দিলে আণবিক বোমা ফাটলেও শুনবেন না। দেব স্যার?
: দাও। এক্ষুণি লাগিয়ে নিই। যাতে তোমার কথাও কানে না আসে। নইলে ফতুর হয়ে যাব। তুমি বউয়ের চেয়েও মারাত্মক, তোমার কথা বউয়ের চেয়েও ক্ষতিকর।

Tuesday 5 December 2017

টিউশনি এবং ভালোবাসা / ড. মোহাম্মদ আমীন

টিউশনি এবং ভালোবাসা         

: একটা টিউশনি করবে?
: কোথায়?
: ষোলশহর।
: ছাত্র না ছাত্রী?
: ছাত্র। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে।
: ছাত্র পড়াব না।
: বিরাট পুলিশ অফিসারের ছেলে। বাবা ডিআইজি। ভালো বেতন দেবে। ভালো নাস্তা পাবে। আরে এতো বড়ো পুলিশের ঝাড়ুদার হতে পারাও ভাগ্যের। সুপারিশে চাকরিও হয়ে যেতে পারে। দুদিন পর আইজিপি হবেন।
টিউশনি শুধু টাকা নয়, টাকার চেয়ে বড়ো কিছু। এটি বিসিএস-প্রস্তুতির একটি মোক্ষম কৌশল, টাকা তো আছেই। রাজি হয়ে যাই রাজীবের প্রস্তাবে।
রাজীব বলল : বেতন মাসে আটশ টাকা।
ঊনিশশ ছিয়াশি, সে সময় আটশ অনেক মোটা অঙ্কের টাকা। এত আকর্ষণীয় বেতনের টিউশনিটা রাজীব নিজে না-করে কেন যে আমাকে দিচ্ছে বুঝতে পারছিলাম না। কিছু সমস্যা তো আছেই!
: তুমি করছ না কেন?
: আমার সময় নেই।
ডিআইজি সাহেবের ছেলের নাম ওমর। ফর্সা, তবে ধবধবে নয় কিন্তু বেশ মায়াময়। বিশাল বাসা, বারান্দায় দামি ফুলের টব। চারিদিকে সমৃদ্ধির ছড়াছড়ি। রাজীব আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে চলে গেল।
ওমর সালাম দিয়ে বলল : স্যার, বিড়াল প্রথম রাতেই মেরে ফেলা উচিত। আমার কথা নয়, আমার ডিআইজি বাবার কথা, ঠিক না?
: ঠিক। কিন্তু বিড়াল কোথায়?
: আছে স্যার, আছে। অনেক বড়ো বিড়াল।
: আমি বিড়াল মারব কেন?
: আপনাকে মারতে হবে না। আমি মারব। একটা কথা বলব?
: বল।
: আগের কথা আগে বলে দেওয়া ভালো। রাখলে আমারও লাভ আপনারও লাভ। নইলে দুজনেরই ক্ষতি। আমি চাই না আপনার ক্ষতি হোক।
: কী কথা বলে ফেল।
ওমর বলল : আপনার বেতনের চল্লিশ পার্সেন্ট আমাকে দিয়ে দিতে হবে। আপনার বেতন আটশ টাকা। চল্লিশ পার্সেন্টে হয় তিনশ বিশ টাকা। তবে আমাকে তিনশ টাকা দিলেই হবে, বিশ টাকা আপনার বখশিস। কী বলেন স্যার?
প্রথমে মাথাটা ঝিম ঝিম করে ওঠে। ইচ্ছে করছিল ঘুরিয়ে একটা চড় দিই। হাত এগিয়ে নিয়েই থামিয়ে ফেলি। মুহূর্তের মধ্যে স্বাভাবিক করে ফেলি আমাকে। তারপর সহজ গলায় আদর মেখে বললাম : কম নেবে কেন বাবা?
: এমনি।
: না, আমি পুরো তিনশ বিশ টাকাই দেব।
: তাহলে স্যার ভাংতি দিতে হবে। আমি একশ টাকার নিচে ভাংতি রাখি না।
: তাই হবে।
বিচিত্র অভিজ্ঞতার আশায় আমার মনটা ফুরফুরে হয়ে ওঠে। মজার হবে টিউশনিটা, দেখি কতদূর যেতে পারে ওমর। মাস শেষ হওয়ার কয়েক দিন আগে আমি একটি খামে করে তিনশ বিশ টাকা ওমরের হাতে তুলে দিই।
ওমর যথাসময়ে টাকা পেয়ে খুশি।
হাসি দিয়ে বলল : স্যার, আপনি খুব ভালো মানুষ।
আমি বললাম : তুমি আমার কাছ থেকে শিখছ আর আমি শিখছি তোমার কাছ থেকে। পরস্পরের বেতন যথাসময়ে দিয়ে দেওয়া উচিত। তাহলে শ্রমের মর্যাদা মাসের প্রথমদিকে হাসার সুযোগ পায়।
ওমর বলল : থ্যাংক ইউ স্যার। সব মানুষ যদি আপনার মতো হতো!
চার মাস পর ডিআইজি সাহেব পড়ার রুমে এলেন। এতদিন তাকে একবারও দেখিনি, বেশ গম্ভীর চেহারা, দেখলে সমীহ আসে। চোখের চশমায়, দামটা পুলিশের পোশাকের মতো ঝিলিক মারছে, হাতের ঘড়িতে আরও বেশি।তিনি ওমরের একটি খাতা হাতে তুলে নিয়ে দেখতে দেখতে বললেন : মাস্টার সাহেব, আপনার বেতন চারশ টাকা বাড়িয়ে দিলাম।
: কেন স্যার?
আমরা পুলিশের লোক। গুণীর কদর করতে জানি। এ পর্যন্ত কোনো শিক্ষক আমার ছেলের কাছে দুই মাসের বেশি টিকেনি। প্রত্যেকে আমার ছেলেটাকে বকা দিয়েছে, মেরেছে, অশ্রাব্য কথা বলেছে। ছেলে কেবল আপনারই প্রশংসা করেছে। আপনি নাকি অনেক ভালো পড়ান।
তিনি একটা কলম ও একটা ডায়েরি আমার হাতে দিয়ে বলেন : এগুলোর আপনার উপহার।
: থ্যাংক ইউ।
কলমটা ছিল সম্ভবত পার্কার। তখন তো আর মোবাইল ছিল না, ওই সময় পার্কার ছিল আমাদের কাছে স্মার্ট ফোনের মতো লোভনীয়।
ডিআইজি সাহেবে চলে যেতে ওমর বলল : স্যার।
: তুমি কী কলম আর ডায়েরি হতেও ভাগ চাইছ?
ওমর হেসে বলল : না স্যার। বস্তুতে আমার আগ্রহ নেই। টাকা হলে সব বস্তু পাওয়া যায়।
: তবে?
: আমার পাওনা এখন চারশ আশি টাকা। আমি আশি টাকা নেব না, একশ টাকা নেব। তার মানে পাঁচশ টাকা।
: ঠিক আছে। খুব বেশি না হলে আমার বেশি দিতে কষ্ট লাগে না। তুমি আমার শিক্ষক, তোমাকে বিশ টাকা বেশি দিতে না-পারলে আমার জ্ঞান অর্জন হবে কীভাবে?
ওমরের হাসিটা আরও বিস্তৃত হলো। কমিশন নিলেও পড়াপাড়ি বেশ ভালোই হচ্ছে।আরও তিন মাস কেটে গেলে। এরমধ্যে, আমার বেতন আরও দুইশ টাকা বেড়ে গেছে। ওমরকে এখন টাকা দিতে কষ্ট হচ্ছে না। জীবনে প্রথম শেখলাম-- দেওয়া- নেওয়ার মাহাত্ম্য। ওমর একটা জীবন্ত স্মার্ট ফোন।
সেদিন বাইরে খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। ওমরকে অন্যদিনের চেয়ে বেশ আনমনা মনে হচ্ছে।
বললাম : কী হয়েছে?
: স্যার, আমাকে একটা কাজ করে দিতে হবে।
: কী কাজ?
: একটা চিঠি লিখে দিতে হবে।
: চিঠি তো লিখেই দিই।গতকালও দিয়েছিলাম।
: স্কুলের চিঠি নয়।
: কোন চিঠি?
: আমার প্রেমিকা; সরি স্যার, বান্ধবীকে দেওয়ার জন্য।
: কী লিখব?
: আপনার মতো করে আপনি লিখে দেবেন। আমি তাকে ভালোবাসি। তাকে না- দেখলে বুকটা কেমন মোচড় খায়। ধকধক করে কলিজা, কিছু ভালো লাগে না। সে খুব সুন্দর ইত্যাদি।
চিঠি লিখে দিলাম গভীর ভাষায়, প্রেমের মমতায়।
রাস্তায় এসে ইচ্ছেমতো হাসলাম। ওমর আর রেহাই পাচ্ছে না। বাসে উঠতে গিয়ে দেখি, ফারহাদ। আমার সতীর্থ এমদাদের ছোটো ভাই। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছে। সাবজেক্টটা ঠিক মনে পড়ছে না।
আমাকে সালাম দিয়ে বলল : ভাইজান, আমাকে একটা লজিং দেবেন?
: আমি তো লজিং নিয়ে থাকি না। এমদাদের কাছে অনেকগুলো লজিং আছে। আমাকেও বলেছে, কাউকে পেলে খবর দেওয়ার জন্য। তাকে গিয়ে বলো।
: বলেছিলাম, দেবে না।
: কেন?
: আমাকে আগে শিবিরের সদস্য ফরমে স্বাক্ষর করতে হবে। আমি শিবির করব না, সেও আমাকে লজিং দেবে না। লজিংগুলির মালিক নাকি শিবির।
ফরহাদকে বিদায় করে নিজের রুমে চলে যাই। শুক্রবার বন্ধুদের নিয়ে বেড়াতে যাবার কথা কিন্তু যাওয়া হলো না। ওমর খবর পাঠিয়েছে, শুক্রবার তাদের বাড়ি যেতে হবে। তার শুভ জন্মদিন।
কী নিয়ে যাই?
অনেক চিন্তাভাবনা করে ওমরের বান্ধবী নিহা নিশিতাকে দেওয়ার জন্য একটা চিঠি লিখি। ওমর চিঠি পড়ে এত খুশি হয় যে, সে মাসের পুরো কমিশনটাই আমাকে ফেরত দিয়ে দিল।
অবাক হয়ে বললাম : ফেরত দিলে যে?
ওমর আমাকে আরও অবাক করে দিয়ে বলল : আপনার লেখার সম্মানি। স্যার, চিঠিটা একদম ফাটাফাটি হয়েছে।
লেখার সম্মানি! আমি চমকে উঠি। লেখার প্রথম আয়, এ তো বিশাল কারবার! তাহলে কেন এতদিন লিখিনি! ওমরের উৎসাহে উৎসাহিত হয়ে পত্রিকায় লেখা শুরু করি। তারপর আস্তে আস্তে লেখা আমার নেশা হয়ে যায়।
যতই গল্প করি, যতই প্রেমপত্র লিখে দিই না কেন, লেখপড়ায় ওমরকে এমন কৌশলে ব্যস্ত রাখি যে, সে ধীরে ধীরে বইয়ে ঝুঁকে পড়ে। তার সব আনন্দ অন্যান্য জায়গা হতে বইয়ের পাতায় এসে ভীড় করতে শুরু করে। আগে তার বাবাকে বলত চকলেটের কথা, এখন বলে বইয়ের কথা। আগে ইলেকট্রনিক্স সামগ্রীতে আলমিরা ছিল ভর্তি; এখন সেখানে ঠাঁই পেয়েছে এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিট্রানিকা, পৃথিবীর বিখ্যাত লেখকদের নানা বই। আমার কাছ থেকে নাম নিয়ে যায় বইয়ের, নিয়ে আসে তার বাবাকে দিয়ে। দেশে না পেলে বিদেশ থেকে। কত দামি দামি বই, আমার কাছে মনে হতো -- সামর্থ্যবানদের ইচ্ছাই প্রাপ্তি।
আরও তিন মাস পর আমার বেতন হয় পনেরশ টাকা। বিশাল অঙ্ক, অনেক সরকারি অফিসারও তখন এত বেতন পেতেন না। এখন ওমরের পাওনা গিয়ে দাঁড়ায় ছয়শ টাকায়।
মাসের শেষদিন ওমরকে ছয়শ টাকা দিতে যাই। লজ্জায় চোখটা নিচু করে ফেলে সে। আগের মতো দ্রুত হাত এগিয়ে দিচ্ছে না : সরি স্যার।
: নাও তোমার টাকা।
: লাগবে না স্যার।
: আরে নাও। আমি অত টাকা দিয়ে কী করব?
: স্যার, একমাসে যতটাকা আপনাকে দিই, আমি একদিনে তার চেয়ে অনেক বেশি দামের চকলেট খাই। একটা চকলেটের দাম একশটাকা, দিনে বিশটা চকলেট আমি একাই খাই। বাবার হুকুমে সুইজারল্যান্ড থেকে আসে। আপনার বেতন মাসে মাত্র দেড় হাজার টাকা।
তারপরও আমি বললাম : নাও।
: লাগবে না স্যার।
: আগে লাগত কেন?
তাস খেলতাম, নিহা নিশাতকে দিতাম। এখন তাস খেলা, সময় নষ্ট মনে হয়। তার পরিবর্তে বই পড়ি। নিহা নিশাতকে যতক্ষণ দিই ততক্ষণ খুশী থাকে, শুধু চায় আর চায়। বই শুধু দিয়ে যায়, কিছুই চায় না।
আমি সাফল্যের হাসি নিয়ে বের হয়ে আসি।
বার্ষিক পরীক্ষার পর ওমরদের বাসায় যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। ডিআইজি সাহেব বলেছেন এক মাস পর থেকে আবার পড়ানো শুরু করতে। আমার মতো ভালো মাস্টারকে তিনি ছাড়বেন না। বদলি হলে সেখানে নিয়ে যাবেন।পনের কী বিশদিন পর দেখি আমার মেস-বাসার সামনে একটা বিরাট গাড়ি দাঁড়িয়ে। দেখলে বোঝা যায় বড়ো পুলিশ অফিসারের গাড়ি।
হন্তদন্ত হয়ে বের হয়ে আসি।
ওমর আর তার বাবা গাড়ি হতে নামছেন।
ডিআইজি সাহেব বললেন : মাস্টার সাহেব, আমার ছেলে বার্ষিক পরীক্ষায় তৃতীয় হয়েছে। এর আগে কোনোদিন পঞ্চাশেও ছিল না। এক বছরের মধ্যে আপনি আমার ছেলেটাকে পরিবর্তন করে দিয়েছেন। এটি আমার কাছে অলৌকিক মনে হয়।
প্রশংসা আমার মনে অদ্ভুত এক আনন্দ বইয়ে দিল।
ডিআইজি সাহেব আমার হাতে একটা ঘড়ি তুলে দিয়ে বললেন : আমার ছোট ভাই আমার জন্য সুইজারল্যান্ড থেকে এনেছেন। আপনাকে দিলাম। এটি কোনো বিনিময় নয়, উপহার; ভালোবাসার নিদর্শন।
আনন্দে আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। এমনভাবে কেউ আমাকে কোনোদিন এমন উপহার দেননি।
ওমর আমার পায়ে ধরে সালাম করে বলল : স্যার, আপনি আমাকে বদলে দিয়েছেনে।
ডিআইজি সাহেব ওমরের এমন আচরণে আবেগপ্রবণ হয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরেন : মাস্টার সাহেব, ওমর আমাকেও পাত্তা দিত না। এ পিচ্চি ছেলের কাছে আমি ছিলাম কেবল টাকার-ঝুড়ি। আপনি তাকে জানোয়ার থেকে মানুষ করে দিয়েছেন। বলুন কীভাবে সম্ভব হয়েছে?
বললাম : ভালোবাসা, শুধুই ভালোবাসা।
: আপনি আমার কাছ থেকে কী চান?
: ভালোবাসা, শুধুই ভালোবাসা।
-------------------------------------------------------------------------------------------
সূত্র : ড. মোহাম্মদ আমীন, ‘শেখা সাদির বোকামি’ গল্পগ্রন্থের একটি আত্মচরিতমূলক গল্প।
ঈষৎ সংক্ষেপিত।
[এই গল্পটি নিয়ে একটি কিশোর উপন্যাস লেখা হয়েছে। নাম ‘ তিনে দুয়ে দশ’। প্রকাশক পুথিনিলয়, পাবেন আগামী একুশে গ্রন্থমেলায় পুথিনিলয়ের স্টলে।]