Saturday 6 February 2016

আল মামুনের অণুগল্পে কবিতার বিজয়কেতন / ড. মোহাম্মদ আমীন

এমডি আল মামুন খান, আমার পরিচিত নন, কোনোদিনও দেখিওনি তাঁকে । ফেসবুকে বিভিন্ন জনের ফেস উল্টোতে গিয়ে হঠাৎ চোখে পড়ে যায় একটি
অণুগল্প ‘ ও সেই আপনারে চিনতে পারলে রে’। দুই লাইন পড়ে যখন আর পড়ব না ভাবতে শুরু করলাম, তখনই গল্পের নায়িকা আর ঘটনার অণুপ্রপাত এসে আমাকে পুরোই টেনে নিয়ে গেল গল্পের বিভরে। তারপর শরু কাহিনির এবং কাহিনি শুরু করতে গিয়ে দেখি শেষ হয়ে গেছে। পুরো গল্পটাই আমাকে এত তৃপ্তি দিয়েছে যে, গল্প শেষ হওয়ার পর আর  আরও কিছু জানার আশায় রাজ্যের সব অতৃপ্তি আমাকে ঘিরে ধরে। এমন তৃপ্তিময় অতৃপ্তি আমি আর পাইনি। এটাই আসলে অণুগল্পের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এমন বৈশিষ্ট্য যার গল্পে আছে, তিনি নিশ্চয় একজন ভালো গাল্পিক। তারপর আরও পড়ার আশায় এমডি আল মামুন খান এর ফেসে মগ্ন হয়ে পড়ি এবং মগ্নতার মাঝে হারিয়ে যাই একটু একটু করে পুরোটই।

ফেস, মানে মুখমণ্ডল। কিন্তু তার ফেস শুধু ফেস নয়, গভীর চোখে কবির মুগ্ধতা, কপোলে শিল্পীর মজ্জাগত পুষ্টতায় রসরস মাদকতা, কপোলে ঘামের মাঝে আল মামুন খানের শব্দ আর শব্দের পাখিরা শিশুর মতো এমনভাবে আমাকে লুফে নিল - কিছুই আর মনে থাকল না। আমি হারিয়ে যাই মামুনের মুখে, কপোলে, গণ্ডে আর চোখের বিস্তৃতির অনাগত রহস্যভরা অণুগল্পের অনুতে অনুতে। তাঁর গল্পের ভাষা প্রাঞ্জল এবং নির্ঝর নিপাটে ব্যাকুল মাদকতায় শিরশির
উৎসব। এখানে চমৎকারিত্বে বিদিক দিশা রঙহীন অগণিত রঙের খেলায় ভেসে বেড়ায় মেঘের মতো বিস্ময় হয়ে। কাহিনি চয়নে তাঁর ব্যতিক্রমতা দৃষ্টির অতলান্ত প্রাপ্তি, পরিণতির সঙ্গে শব্দের গাঁথুনি মিলে সৃষ্টি করে অদ্ভুদ মাদকতা। পাঠক হারিয়ে না গিয়ে পারে না লেখকের শব্দের আহ্বানে। দেখুন, আল মামুনের  ‘হলুদপাতার নিঃসঙ্গতা অণুগল্পের একটি অনুলাইন : “ প্রত্যাখ্যাত প্রেমে হলুদ পাতার বর্বিণতায় ভেসে  ভসে, চরম জঘিাংসাকে বুকে নয়িে ভালোবাসার এক পশলা বৃষ্টস্নিাত কোমলতায় ডুবে ডুবে স্বাভাবকি হতে চাইছে এক বষিণ্ন পাতা ঝরার দনি।ে” কবিতার চেয়ে মনোহর, সুরের চেয়ে মুগ্ধকর এ লাইনগুলো দার্শনিক উপলব্ধির প্রকৃষ্ট উদাহরণ। লেখকের মন দর্শনের অন্তরালে আলোড়িত না হলে এমন বাক্য আসে না। প্রতিটি বাক্য যেন গল্পের সমাহারে উথলে পড়া কবিতার বাষ্প।

প্রকৃতি তাঁর লেখার ক্যানভাস, প্রেমরঙে বিচ্ছেদ আর প্রাত্যহিকাতায় মসলায় তিনি গড়ে তুলেন গল্পের প্রাসাদ, স্বপেনর জগত। নাম অণুগল্প কিন্তু পড়ার পর অনুভূতির তীব্রতা ছড়িয়ে পড়ে শরীরের প্রতি কোষে, আদিমতার সারল্যে মন বিকশিত হয়ে উঠে  ভালোলাগার পরশে। অণু ক্রমশ বিশাল হয়ে ধরা দেয় চোখের নেশায়, হৃদয়ের অনুভাষ্যে। তাঁর গল্পে আছে ভালবাসা, ভালবাসায় আছে অুনরাগ আর ওই অনুরাগের ক্ষণ চিন্তাকে কাছেই ভিড়তে দেয় না। রাগ তার অনুরাগের ভেতর ঢুকে এলোমেলো করে দেয় সব পরিকল্পনা, শুধু কল্পনাটাই বেঁচে থাকে সঞ্জীবনী সুরার মতো পরিকল্পনাহীন  প্রেমের অপ্রতিরোধ্য গতি হয়ে : “ এক লখেকরে সাথে লখিতে লখিত,ে এক লখেকিার সর্ম্পক হয়ে গলে। সখোনে ভালোলাগা কি প্রমে কংিবা ভালোবাসা না অন্য কোনো অনুভবহীন অক্ষমতায় পুড়ে যাওয়া অন্য কছিু ছলি, তা জানার প্রয়োজন দখেি না।”

মানুষকে তিনি দেখেন নিজের চোখে কিন্তু নিজের মতো করে। সাধারণত মানুষ অন্যকে দেখে নিজের চোখে অন্যের মতো করে। কিন্তু মামুন দেখেন নিজের চোখে নিজের মতো করে। এখানেই তাঁর দৃষ্টি আর সাধারণ্যের দৃষ্টির পার্থক্য। অন্যের অনুভূতিতে তাঁর গভীর বেদনাবোধ অন্ধবিলাসের কল্পিত মৌকর্ষ। তিনি লিখতে পারেন, প্রকাশ করতে পারেন- অনেকে পারেন না। তাতে কী! তিনি অন্যের ভাবনাগুলো ঠিক চিনে নিতে পারেন এবং নিজের ভাষায় প্রকৃতির মতো সার্বজনীনতায় প্রকাশ করতে পারেন। এটি তার গল্পের বিরল সার্থকতার নিলয় মাধুর্য। মামুনের চেতনা হতে বিকশিত কথারা রবীন্দ্রনাথের মাধুর্যে আধুনিকতার পরশ, দর্শনের গহ্ববের অনুসন্ধানের কৃতিত্ব। তিনি জানেন, ভালবাসাটা এক একজনের কাছে এক একরকম। তাই তার প্রকাশভঙ্গীটাও ভিন্ন। এই ভিন্নতা কী বুঝতে পারা এবং সহজ সরল ভাষায় ছোট পরিসরে ব্যক্ত করতে পারাই গাল্পিকের সবচেয়ে বড় গুণ। এ গুণটা বেশ আলোকিতভাবে আছে জনাব মামুনে। অপরের হৃদয়কে পাঠ করার বিরল গুণ রয়েছে তাঁর। তাই অবলীলায় বলে যেতে পারেন লীলাময় বিবরণ : “হৃদয় বলতে কছিু একটা যে শরীররে ভতের ওর অজান্তে ওকে হৃদয়বতী করে তুলছ.ে.. একটু একটু... পলকে পলক,ে এক গোপন শহিরণ নতুন চররে মত জগেে উঠা হৃদয়রে শুণ্য প্রকোষ্ঠে গড়েে বসছ!ে যা ওকে দোলায়, ভীত কর,ে আবার কাছে টানার মত ভদ্রগোছরে দূরত্ব ও রখেে যায়।”

তাঁর লেখক সত্ত্বা জাগতিক সূত্রের এলেবেলে উৎপল। সাধারণত মানুষ প্রেমের পর লেখক হন, ভালবাসার চড় লেখক হতে বাধ্য করেন কিন্তু ্আল মামুন
উল্টো। লেখক হওয়ার পরই তিনি ভালবাসতে শিখেছেন। এ যেমন দর্শনের স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর দর্শন শেখা। তাঁর নিজের ভাষায়, “ যখন লেখক হলাম একটু আধটু, কবেল ভালোবাসা জন্ম নতিে থাকলো। এর বপিরীতে কনে জানি চাইলওে যতেে পারি না।” এমন অভিজ্ঞতা তাঁকে করেছে আবেগহীন আবেগে ঋদ্ধ। লেখার সময় আবেগকে টেনে ধরে নিজের ইচ্ছেমতো গল্পের লক্ষ্যে ধাবিত করার বিরল গুণ রয়েছে তাঁর। লেখক হওয়ার পর তিনি পুরোই লেখক, ভালবাসায় পুরোটা ভালবাসা এমন মজ্জাগত একাগ্রতা আল মামুনের অণগুল্পের অনুস্বর।

আমি জানি না, কয়জন লেখকে এমন বাঙময় চঞ্চলতা রয়েছে, রয়েছে এমন দিক্সময় পরিপক্কতা। নবীন লেখক হলেও তার অণুগল্পে অনেক পরিপক্কতার ছাপ, এটি বয়সের ছাপ নয়, দক্ষতার নিদর্শন। পড়তে পড়তে আমি অন্য জগতে চলে গিয়েছিলাম - তাঁর গদ্যকে পৃথক করতে পারছিলাম না পদ্য হতে।
তবে পার্থক্য আছে- মামুনের গদ্যে, পদ্যের গভীরতা কিন্তু পদ্যের মতো জটিল নয়, পাঠক সহজে পড়ামাত্র বুঝে নিতে পারেন প্রতিটি অক্ষরের বিন্যাসের প্রতিহাস। তাঁর গল্প কবিতার মতো ছন্দোময় কিন্তু আবেশটা কবিতার চেয়ে ঢের, গানের চেয়ে অভিনব। কারণ এখানে অতৃপ্তির যে নেশা, তা নিটোল প্রেমিকের জোয়ারভাঙা বিরহের চেয়েও প্রবল। তাই মামুনের অণুগল্প কবিতার বিজয় কেতন, সুরের মোহনায় দর্শনের অনুভূতি এবং প্রেমের কোড়কে জীবনের অভিধান। পাঠক আপনার সবকিছু খুঁজে পাবেন এখানে- সব অনুভূতি। তৃপ্ত হবার বিপুল উপাদান রয়েছে এখানে। তার অণুগল্প জীবনবোধের নিটোল অনুভব।


No comments:

Post a Comment