Thursday 4 February 2016

মোহাম্মদ সরওয়ার হোসাইন আজিজ : মুগ্ধকর স্নিগ্ধতা / ড. মোহাম্মদ আমীন

আমার অনেক বন্ধু, পাঁচ হাজারের কাছাকাছি। সবার ফেস দেখা সমবসময় সম্ভব হয় না। এটি আসলে কারও পক্ষে সম্ভব নয়। তবে যথাসম্ভব সবাইকে দেখার, সময় পেলে এক ঝলক ঘুরে আসার চেষ্টা করি। সেদিন বন্ধুমহলে ঘুরতে ঘুরতে অকাস্মাৎ পেয়ে যাই একটি ফেস, একটি অসাধারণ মুখ। দেখতে দেখতে চোখ অপলক, লোমকূপে ঘামের প্রহর, অনবদ্য এক ফেস, জড়িয়ে ধরা কুমারী মতো রমণীয় সব লাইন, ছবি, লাইনের পর লাইন, গদ্য এবং কবিতা : 
”আমরা উলংগ ছিলাম
এখোনো নগ্নতার প্রতি ঝোক আছে
আধুনিকতার দোহাই দিয়ে
আবারো কি ফিরে চলেছি ফেলে আসা দিন গুলোয়?”

ভাবতে বাধ্য করে আমাকে, চলতে গিয়ে লাইনগুলোর ফাঁদে আটকে যাই। রমণীয় কুহক, এত সহজে রেহাই নেই। থেমেই চোখ দিই অতীতে। ঠিকই তো! আমার উলঙ্গ ছিলাম, আমাদের শিশুরা এখনও উলঙ্গ হয়ে জন্মাই। সুযোগ পেলে নগ্ন হওয়ার তালে থাকি আমরা, সভ্যতা  নগ্ন হওয়ার জন্য মগ্ন হয়ে নগ্নতার দিকে দৌড়াচ্ছে হন্যে হয়ে। ওয়াল্লা- এ তো ভয়ঙ্কর কথা কিন্তু চোখে পড়েনি কেন এতদিন? তাহলে আমিও কি নগ্নতার দিকে চারিপাশ ভুলে, সবকিছু হাতে নিয়ে মগ্ন হয়ে দৌঁড়াচ্ছিলাম? এত মগ্নতা ভালো নয়, নিজের দিকে তাকাই, অঘটন ঘটে যাবার আগে পরিচ্ছদ আটকাই। স্বস্তি আসে একটু, এমন কবিতা ভাবনায় বেঁধে ফেলতে পারে, দিতে পারে স্বস্তি।


“দরিয়া !
ডুবে আছি তোমার প্রেমে
কখনো ডলফিনের মত ভেসে কিন্তু, রয়েছি তোমার বুকে

জীবন হবে এতো যে সুন্দর ভাবিনি কখনো আগে
আমি যে রয়েছি ভেসে বা ডুবে তোমার কোমল বুকে।
প্রিয়”


এবার কবির নামটা পড়লাম, মোহাম্মদ সরওয়ার হোসাইন আজিজ। মুখটাও দেখলাম : গামছায় জড়িয়ে আছে পাঞ্জাবি সাদা, খোচা খোচা দাড়িগুলো জামির দুপাশে দুটো তুষারশুভ্র মাউন্ট আরারাত যেন। নোহার অপেক্ষায় উদাস তাকিয়ে অতীতে হয়ে ভবিষ্যতের নীলিমায়। চোখ দিয়ে স্ফুরিত হচ্ছে নির্ভরতা, বর্তমান আগুন হয়ে ধেয়ে চলছে অতীতের দিকে, একটা ছবিতে তিনি গভীর আগ্রহে বইয়ে ডুবে। আজিজের চশমার মোটা-কালো ফ্রেম, ফ্রেম দুটো খুব যত্নে ঢেকে রেখেছে চুলের মতো আবেশ নিবিড় করে দুটো কালো চোখকে। চাহনিতে পুরো মুখ, পুরো আজিজ আকাশের মতো চেয়ে আছে অবারিত হাসির নিশির অবাক বাশীতে। 

মোহাম্মদ সরওয়ার হোসাইন আজিজ, ফেসবুক ফ্রেন্ড - চেনা কী? বুঝতে পারি না, নামটাও না- চেনার দলে। স্মৃতি হয়তো প্রতারণা করছে, যত বয়স বাড়ছে তত বেশি প্রতারিত হচ্ছে স্মৃতি হতে। যাক, চেনার কী প্রয়োজন, সে তো কবি; কবিকে চেনে না এমন জীব আমাজানের উলঙ্গতায়ও নেই, রাজনীতির পাথুরে মঞ্চেও কবিতা হয়। রোয়াঙছড়ির
বনেও কবিতা উড়ে পত পত পাখায়। খুনির শিকার খুনেও ঝরে কবিতা - কবি সর্বত্র অবধারিত আলো, বিস্মিত ঘুমের নিদ্রিত আঁধার। তাই মোহাম্মদ সরওয়ার হোসাইন আজিজকে না চিনলেও ক্ষতি নেই। তার কবিতা বড় পরিচিত আমার, সংসারের মতো, প্রতিদিন বাইরে যাওয়া দরজার দেওয়ালে সেঁটে রাখা আমার সন্তানের ছবির মতো।

অথৈ, নিশি, দরিয়া, প্রিয়া এবং প্রিয়কে নিয়ে মোহাম্মদ সরওয়ার হোসাইন আজিজের মনোজগত। একটি তার কবিতা অন্যটি গদ্য, দুটো মিলে তার সংসার, মানে সাহিত্য। তাহলে প্রিয়া কে? প্রিয়া প্রিয়াই, প্রিয়ার সাথেই তার সহবৎ, চিন্তাগুলোর কবিতার রূপ ধরে গদ্য হয়ে প্রিয়ার গভীর মিনারে বীর্য হয়ে ঢুকে বের হয়ে আসে নিটোল সাহিত্য হয়ে। এমন প্রেম বড় বিরল, এমন কবিতা এত বিস্ময়কর যে বিস্মিত করার সুযোগ দেয় না। এ যেমন আমরা ডুবে আছি আমাদের অজান্তে বাতাসের সাগরে।আমরা কী তা বাতাসহীনতা না পড়লে অনুভব করি? তেমিন তিনি, আমাদের আজিজ। মানে মোহাম্মদ সরওয়ার হোসাইন আজিজ, তার সংসার, সাহিত্য আর প্রেম।
“অথৈ !
তুমি কি আমার বাশির রাগিণী ! 
এ রাগ মায়ায় জড়ায়ে কাছে টানে, নাকি বিরহের রোদনে বাশিয়ে দেয় ভিজিয়ে... 
বলতে পারো অথৈ !
প্রিয়।”

আজিজের কবিতা শব্দের বাগান এবং ছন্দের প্রবল চড়ে ঝিম মেরে থাকা জীবনের সার। তাহলে তার গদ্য? কবিতার দিকে ধেয়ে আসা ঢেউ। আজিজের কাছে তা আরও অনুপম, আরও নেশাময় দ্রাক্ষা এবং নিতুই নিতুই ব্যতিক্রম। কবিতা তার সারাক্ষণ গদ্য এবং গদ্য তার কবিতার কেবল যমজ নয়, চোখের জল, অভিন্ন প্রবাহে যমুনা হয়ে মেঘনায় এবং ভেনাস হয়ে প্রেমের সুস্মিতা ইউফ্রেতিস, সর্বত্র ছড়িয়ে জলের মতো মুগ্ধতায় । দেখুন না, তাহলে কী গদ্য তার, কেমন লিখেন আমাদের আজিজ : “অথৈ ! কোন কিছুতে মন বসছে না, টিভি বিরক্তিকর লাগছে! চা - কফি বললেই হাজির হবে। কিন্তু নাহ! ইচ্ছে হচ্ছে বাইরে কোথাও তুমি - আমি মুখোমুখি বসি, কফির পেয়েলা হতে উবে যাওয়া বাষ্পের সাথে মনের জ্বালা মিলিয়ে দেই। রাজনৈতিক নেতৃত্বকে অভিশাপ দিতে দিতে তপ্ত -উত্তপ্ত মন শান্ত- শিতল করি। প্রিয়।”

তার লেখা কবিতার চেয়ে কাব্যময়, গদ্যের চেয়ে মৃণ্ময়, গল্পের চেয়ে বাঙ্ময় কটি লাইন আজিজের সাদা পাঞ্জাবির শুভ্রতা হয়ে সবুজের প্রান্তকে অবহেলা করে নিজেই সুবজ, তারপর ক্রেওক্যাডাং মাড়িয়ে আবার নিশিতে কারুকার্য, তবে শ্রাবস্তীর নয়, কোনো উদাহরণ আনা যায় না তার গদ্যে, শধু গদ্যটাই উচ্ছ্বল হয়ে ভেসে থাকে বিকেলে, সকালে এবং
নিশিতে : “নিশি! তুমি এমন কেন? মাঝে মধ্যে তোমার অনুজ "নিদ্রা" কে কেনো আমার কাছ হতে এত দূরে রাখো ? তার সুকোমল সুরভিত বুকে নিজেরে হারাই ... কিন্তু হায় ! তার বিরহ যন্ত্রণায় ছটফট করি একা বিছানায়...” তারপর দেখুন পরক্ষণ কোথায় চলে গেলেন কোত্থেকে, সুরের আবহকে ভীষণ মায়ায় প্রসূন করে :
“কালোমেয়ে ! এই কালোমেয়ে !! তুমি এমন কেনো ?!!!
জানি,অপরূপ রূপ তোমার, তোমার রূপের মোহে ঘর ছাড়ি,অপলক চেয়ে থাকি... কিন্তু তুমি যে অধরা !
দোহাই তোমার নিস্তব্ধতার! দয়া করে আমাকে প্রিয়তমার বুকে সঁপে দাও...।রবি।।”

প্রতিনিয়ত কবি মোহাম্মদ সরওয়ার হোসাইন আজিজের কবিতা প্রেমের পেমে বিরহের সুর, আবেগের স্তব্ধতায় কখনও শিউলি কখনও বা প্রিয়ার উষ্ণবুকের সৈকত। তিনি উদার উদারতায় খুলে রাখেন নিজেকে সবসময়, সবার জন্য। বঞ্চিতরা তার কবিতায় প্রেমের শব্দে বড় মায়ায় স্থান পায়, ক্ষুধিতরা পায় অন্ন আর নির্যাতিতদের জন্য তিনি তো অবিরাম ক্ষুধিরাম। তিনি অবারতি কথা এবং মুগ্ধকর স্নিগ্ধতা। 

“শিউলী !
যদি পড়ো ঝরে
এসো এ বুকে
তোমার ই জন্য
রেখেছি পেতে ...
প্রিয়।”

আমি জানি না  সরওয়ার হোসাইন আজিজের কোনো লেখা গ্রন্থাকারে প্রকাশ হয়েছে কিনা। হোক বা না হোক, তাতে কিছু আসে যায় না, বাতাসে কান পাতলে তাকে শোনা যায়, শোনা যায় তার কবিতা, শরীরে লাগে তার গদ্যের তীক্ষ্ণ পাথরের আচড়। রাজনীতি হতে ঘরের কোণায় পড়ে থাকে ফুলের পুরানো ডালিটাও এড়ায় না তার চোখ। জীবনের প্রতিটি সূত্রকে তিনি একসঙ্গে বেঁধে সৃষ্টি করতে পারেন অভাবনীয় এক পরিবেশ। ভালবাসা তার মজ্জাগত, অভিমান তার প্রথাগত আর হৃদয় অবিকল সবাতে সমাহিত আতলান্তিক। জীবনকে তাই তিনি সবকিছুর সমন্বয়ে গড়া অভিযান
মনে করেন। এখানে প্রেম হতে রাজনীতি, অর্থনীতি হতে নৃতত্ত্ব - সব আছে মিলেমিশে একাকার হয়ে। আজিজ লিখেছেন : “অভিমান করে আছো কত দিন লিখিনি। মন শুধু বিষন্ন নয় বিক্ষিপ্তও বটে। দেশে আন্দোলন /রাজনীতি এখন বড় কোন ময়দান বা ভবন হতে নয় কূটনৈতিক পল্লী হতে নিয়ন্ত্রিত হয় বলে লোক মুখে শুনাযায়। বিশেষ বিশেষ সময়ে ডিপ্লোমেটগন ছুটে যান আবার নেতারাও ধর্না দেন, পত্রিকার পাতায় খবর হয়ে ছাপা হয়।আমরা জানতেও পারিনা কি শলা পরামর্শ হয়।অথচ আমরা জনগন নাকি রাষ্ট্রের মালিক।হা হা হা.... প্রিয়।”

আজিজের কবিতা মানে জীবন,  গদ্য মানে প্রকৃতি। এ ছাড়া আর কী আছে? তিন অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যতের অবতার, বিনয়ের মাঝে ব্যক্তিত্বের পরশ। তিনি ভাঙবেন, মছকাবেন না। মনুষ্যত্ববোধের প্রীতি তার  ঐতিহ্যে ফুলে ফুলে কবিতায়। শূন্য থালাতেও তাই ফুলের সমহার। এ আমাদের বন্ধু সরওয়ার হোসাইন আজিজ।নেশায় নেশায় বুঁদ করে তুলে কথায় কথায় ছন্দের মোড়কে :
“অথৈ !
আস্তর খসে পড়ছে, দরজা ঘুনে ধরে বয়সের ভারে ভংগুর, সিড়িতে ফাটল ..... 

কিন্তু রুচিবোধ ! 

পরিচ্ছন্নতা ফুলের টব বলে দেয় কয়েক প্রজন্মে 
অর্জিত আভিজাত্যবোধ দারিদ্র কেড়ে নিতে পারে না।
প্রিয়।”


আজিজ একজন উন্নত মানুষ, আদশ অনেুভবে তাড়িত। ‍সহজে সবাইকে কাছে টেনে নিতে পারেন অবলীলায়, খুব আপন করেএমন সুন্দর সাদা মনের মানুষ সহজে চোখে পড়ে না, তিনি আমাদের কাছের মানুষ এবং একজন ভালো বন্ধু

No comments:

Post a Comment