Tuesday 2 January 2018

সুভাষ সর্ব্ববিদ্যা : কাব্যে-গল্পে অভিজ্ঞতার নির্ঝর প্রসর / ড. মোহাম্মদ আমীন

সুভাষ সর্ব্ববিদ্যা : কাব্যে-গল্পে অভিজ্ঞতার নির্ঝর প্রসর

(খসড়া)

ফেসবুকে বিভিন্ন জনের আইডি উল্টোতে গিয়ে হঠাৎ চোখে পড়ে যায় সুভাষ সর্ব্ববিদ্যার আইডি। ইচ্ছা ছিল একটু
দেখে অন্য কারো আইডিতে চলে যাব। কিন্তু একটা স্ট্যটাস পড়ার পর আর একটা পড়ার ইচ্ছা প্রবল হয়ে উঠল। এভাবে পড়ার ইচ্ছা ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছিল। লেখা নয়, জন্য রোমাঞ্চিত হওয়ার মতো কিছু জীবনালেখ্য। কবিতার পর গল্প, গল্পের পর আবার কবিতা এভাবে সজ্জিত ফেসবুক আমাকে ধীরে ধীরে আকৃষ্ট করে তুলছিল।  মোহময় করে তুলছিল তমার উপস্থিতি, তমার নির্মাল্য। বিভ্রান্ত করে দিচ্ছিল গল্পের অনুভবে নিবিড়-মজ্জায় ঝড় তোলা জীবন্তিকা। সুভাষ সর্ব্ববিদ্যার লেখা কোনো কল্পমাত্র নয়, বাস্তবতার জীবন্ত বিন্যাস, অভিজ্ঞতার মর্মর নির্যাস। সর্ব্ববিদ্যার আইডি আমাকে এত তৃপ্তি দিয়েছে যে, শেষ হওয়ার পর আরও কিছু জানার আশায় রাজ্যের সব অতৃপ্তি ঘিরে ধরে। এটাই আসলে শিল্পসম্মত লেখার বৈশিষ্ট্য। এমন বৈশিষ্ট্য যার  লেখায় আছে, তিনি নিশ্চয় ভালো লেখক। সুভাষ সর্ব্ববিদ্যা একজন ভালো লেখক।
  
মূলত তিনি গল্পকার। তবে কবিতাতেও সমান দক্ষ। প্রথম তাঁর যে বইটি আমি পড়ি সেটি ‘বিদীর্ণ বালুচর ও অন্যান্য’। চোরাটান, বিদীর্ণ বালুচর, হাশেম আলী মাস্টার, ফ্রেমে বন্দি ছবি, বুবানি, দুর্মতি এবং আলো-ছায়া ও একটি ঘুণপোকা- এ ছয়টি ছোটগল্প নিয়ে গ্রন্থটির অবয়ব। জীবনের তিলতিল অনুভব থেকে পাওয়া অভিজ্ঞতার সমন্বিত প্রকাশ গল্পগুলোকে অসাধারণ করে তুলেছে। এ শুধু গল্প নয়, প্রাত্যহিক জীবনের বাস্তব রূপায়ণে কর্মজীবনের সান্নিধ্য সোহাগÑ কষ্টের বিমূর্ত সোহাগে গড়ে ওঠা জীবনবৃক্ষের অপরাজেয় গল্প। পড়া শুরু করলে না-শেষ করে ছাড়া যায় না। 

এমন জীবনধর্মী গ্রন্থ, পাঠকের অনুভবকে শাণিত করে তুলতে পারে জীবনবোধের পূর্ণ-মহিমায়। গ্রন্থের প্রচ্ছদটাও হয়েছে চমৎকার। তবে লেখাগুলোর ফন্ট স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা ছোট করায় আমাদের মতো বুড়োদের পড়তে কষ্ট
সুভাষ সর্ব্ববিদ্যার গল্পগ্রন্থ
হয়। হয়তো খরচ কমানোর জন্য এমনটি করা হয়েছে। ‘বিদীর্ণ বালুচর ও অন্যান্য’ বাংলা সাহিত্যের ছোটগল্প-সম্ভারে একটি অনবদ্য সংযোজন। সুভাষের গল্প জীর্ণ জীবনের ভিন্নকথার লাল জুঁই। রক্তগুলি এখানে বিকট উর্মীতে জীমুত হয়ে আকাশে ছুটে যায়। লাইনে লাইনে কষ্টকর মুগ্ধতা, শিল্পীর মজ্জাগত পুষ্টতায় রসরস মাদকতা এবং শ্রমঘামের মাঝে শব্দ আর শব্দের পাখিরা শিশুর মতো অর্থহীন অর্থে অবিরাম গেয়ে যায় কিচির মিচির। তাঁর গল্পের ভাষা প্রাঞ্জল এবং নির্ঝর নিপাটে ব্যাকুল মাদকতায় শিরশির উৎসব। প্রতিটি বাক্য সহজবোধ্য, সরল এবং অকপট। এখানে চমৎকারিত্বের বিদিক দিশা রঙহীন অগণিত রঙের খেলায় ভেসে বেড়ায় মেঘের মতো বিস্ময় হয়ে বুকের কষ্টে মনের যাতনায়।

কবিতায় শব্দ চয়নে সুভাষের ব্যতিক্রমতা দৃষ্টির পরে আরও দৃষ্টির উপলব্ধক প্রাপ্তি। এ এক অনবদ্য অনুভব, পরিণতির সঙ্গে শব্দের গাঁথুনি মিলে সৃষ্টি করে অদ্ভুদ মাদকতা। পাঠক হারিয়ে না গিয়ে পারে না শব্দের আহ্বানে। দেখুন, কীভাবে তিনি তুলে ধরেছেন জীবনকে সমাহিত বিচূর্ণতায় :
“তোমার মায়াবী ঠোঁটের উষ্ণ চুম্বন
আগুনের ইতিহাস খুঁজে।
তোমার পত্র লেখা শুধরে দেবার সুবোধ স্যার এখন আর নেই।
-----
তমা,এখনও কি তুমি শুনতে পাও 
শরতের শিউলি ঝরা গান?” 

 লাইনগুলি সুভাষের কবিতার কিন্তু কবিতার চেয়েও মনোহর, কষ্টের চেয়ে বিধুর, সুরের চেয়ে মুগ্ধকর, উপলব্ধির চেয়েও বাস্তব এবং অনুভবের চেয়েও  রোমাঞ্চকর। কবির মন দর্শনের অন্তরালে আলোড়িত না হলে, সুকুমারচিত্ত কৌমার্যের উন্মাদনায় নিয়মের রশি ছিঁড়ে বের হওয়ার প্রয়াস নিয়মহীন নিয়মের মতো গর্জে না উঠলে এমন বাক্য আসে না। প্রতিটি বাক্য যেন অভিজ্ঞতার সমাহারে উথলে পড়া আবেগের লালায়িত বাষ্প। কষ্টগুলিকেও তিনি মিষ্টতার আবরণে উপভোগ্য করে তুলেন নিখাদ অভিমানে : 
তুমি আসবে ভেবে
চাঁপা বনে যাইনি।
কলঙ্কিনী চাঁদ কি
সবুজাভ হয়েছিল?” [সুভাষ সর্ব্ববিদ্যা]

সুভাষ সর্ব্ববিদ্যা সুভাসিত ভূষণে বিভুষিত সাধারণ জীবনের একজন অসাধারণ মানুষ। সহজসরল এবং অমায়িকতা তার মজ্জাগত বৈশিষ্ট্য। মুখ থেকে বের হয়ে আসা নরম শব্দের পরম আতিথেয়তা মুহূর্তে রাশি রাশি ¯েœহ হয়ে টেনে
নিতে পারে অপরিচিত যে কাউকে। অল্প পরিচয়েও সে আমার প্রিয় একজন। অবশ্য, প্রিয় হতে সময় নয়, মনোবৃত্তিক ঔদার্যের প্রয়োজন। এটি তার পুরোপুরি রয়েছে। সুভাষ লিখেন কষ্ট নিয়ে। মানুষের কষ্ট, বোধের কষ্ট, জীবনের কষ্ট, মরণের কষ্ট, সুখের কষ্ট শান্তির কষ্ট। তাঁর দৃষ্টি সাধারণ কোনো দৃষ্টি নয়, দার্শনিক আলোর অসীম দৃষ্টি। তাই সুখেরও যে কষ্ট আছে তা-ও তিনি দেখতে পান। বৃষ্টির শব্দে তিনি কান পাতেন না শুধু, নাকও পাতেন ঘ্রাণ নিতে। তাঁর ‘বৃষ্টির ঘ্রাণ’ গল্পে এটি বিমূর্ত। কবিতায় তিনি অদম্য। ছোটো ছোটো লাইনে সহজ শব্দগুলি জীবনের জটিল মুহূর্তগুলিকেও সাগরের ফেনিল বিশালতায় নিমজ্জিত করে দেন। কষ্টকেও তিনি তাই ভোগ করতে পারেন সুখের প্রশান্ত মাদকতায়। নিজেকেও বাদ দেন না, তীক্ষ্মনাগ্র তীরের ফলা দিয়ে ফলা ফলা করে দেন : 
“স্বার্থপরের সুমার হলে
                                   ‘নামটা আমার আগে দিও। [ সুভাষ সর্ব্ববিদ্যা]

জীবনের নানা ঘাতপ্রতিঘাত তাঁর গল্পকবিতার রক্তমাংস এবং প্রতিনিয়ত অর্জিত অভিজ্ঞতা এর নিঃশ্বাস। তাই যত কষ্ট আসুক, যতই বিপন্নতায় মুষড়ে পড়–ক, তিনি অকুতোভয় নেই। তিনি প্রেমের বাগে, বাঘের কাঁধে ছুটে বেড়াতে পারেন সখীর কৃষ্ণরৌপ্যের সন্ধানে। অন্তদর্শনে সুভাষ অতুলনীয়। কেবল ভিতর-বাহির নয়, এ দুটির ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়াও তাঁর চোখ এড়ায় না। কোনো ফাঁক না রেখে দ্বিধাহীন বলে যান : 
                           “বৈচিত্র্যময় মানব জীবন বাইরে থেকে পরিলক্ষিত হয়না তবুও সে প্রাণবন্ত। পুষে রাখে কষ্ট                                      যন্ত্রনা। এরপর....অনেক কথা হলো। শৈশব  কৈশোর যৌবন....। আজ দেখে এলাম তার,                                          সুখের কালশিটা!” 

এমন আবেগময় বাক্যগুলি পড়লে  মনে হয়, আমাদের দৃষ্টি তার দৃষ্টি হতে অনেক পিছিয়ে। দুঃখের সঙ্গে আজন্ম সান্নিধ্য তাঁকে দুঃখের রাজ্যে সুখের অভিবাসন গড়ে দিয়েছে। তাই শত কষ্টও সুভাষকে ভাঙতে পারে না বরং কষ্টকে উপহাস করে দিব্যি এগিয়ে যান। কষ্টকে প্রশ্নের উদরে ঢুকিয়ে তিনি নিয়ে আসেন ফুটফুটে শিশু। নিজের দুর্ভাগ্যকে সৌভাগের নায়ে ভাসিয়ে প্রশ্ন করে বসেন ভগবানকে :

         “-- ভাগ্যবানের বোঝা নাকি ভগবান বয়।
             তমা, ও তমা,
            তুমি কি জানো- দুর্ভাগার বোঝা কে বয়?” 
প্রকৃতি আর জীবনের বাস্তবতা সুভাষ সর্ব্ববিদ্যাল লেখার ক্যানভাস, প্রেমরঙে বিচ্ছেদ আর প্রাত্যহিকাতায় মসলায় তিনি গড়ে তুলেন গল্পের প্রাসাদ, স্বপনের জগতৎ, সুড়কি তার কষ্ট। সুভাষের গল্পগুলি পড়ার পর অনুভূতির তীব্রতা ছড়িয়ে পড়ে শরীরের প্রতি কোষে, বিষ্ফোরণ ঘটনায় আনবিক বোমার মতো। দিব্যদর্শনে মন বিকশিত হয়ে ওঠে  ভালোলাগার পরশে। জীবনের কষ্টগুলি গল্পের  বাক্যে ক্রমশ বিশাল হয়ে ধরা দেয় চোখের নেশায় এবং হৃদয়ের অনুভাষ্যে। তাঁর গল্পে আছে ভালোবাসা, ভালবাসায় আছে অুনরাগ আর ওই অনুরাগের ক্ষণ চিহ্নকে কাছেই ভিড়তে দেয় না অতৃপ্তির অবরোধে। তাই কষ্টতেও তাঁর অতৃপ্তি নেই। জীবনের চেয়ে তৃপ্তি আর কী আছে! তার কোনো কিছুতে পরোয়া নেই :
                  “স্থির বিদ্যুতের মতো
                   জমে আছে বুকের এক ধার।
                  তবুও জীবন চলে
                 নির্ভীক বাধাহীন দূর্বার।”

রাগ তাঁর অনুরাগের ভেতর এবং সুখ তার কষ্টের ভিতর ঢুকে এলোমেলো করে দেয় সব পরিকল্পনা, শুধু কল্পনাটাই বেঁচে থাকে সঞ্জীবনী সুরার মতো পরিকল্পনাহীন  প্রেমের অপ্রতিরোধ্য গতি হয়ে। 

মানুষকে তিনি দেখেন নিজের চোখে কিন্তু নিজের মতো করে নয়, প্রত্যেকের মতো করে। এভাবে দেখার জন্য যে চোখ, যে দৃষ্টি এবং যে ধৈর্য ও অন্তর প্রয়োজন সবকিছু তার আছে। সাধারণত মানুষ অন্যকে দেখে নিজের চোখে অন্যের
হায়াৎ মামুদ ও সুভাষ সর্ব্ববিদ্যা
মতো করে। কিন্তু সুভাষ দেখেন নিজের চোখে নিজের মতো করে প্রত্যেকের চেতনার রসে সিক্ত হয়ে অনুভবের নীহারিকায়। এখানেই তাঁর দৃষ্টি আর সাধারণ্যের দৃষ্টির পার্থক্য। অন্যের অনুভূতিতে তাঁর গভীর বেদনাবোধ অন্ধবিলাসের কল্পিত কৌমার্য। তিনি লিখতে পারেন, প্রকাশ করতে পারেন- অনেকে পারেন না। তাতে কী! তিনি অন্যের ভাবনাগুলি ঠিক চিনে নিতে পারেন এবং নিজের ভাষায় প্রকৃতির মতো সার্বজনীনতায় প্রকাশ করতে পারেন। এটি তার গল্পের বিরল সার্থকতার নিলয় মাধুর্য। সুভাষের চেতনা হতে বিকশিত কথামালা রবীন্দ্রনাথের মাধুর্যে আধুনিকতার পরশ, দর্শনের গহ্ববের অনুসন্ধানের কৃতিত্ব। তিনি জানেন, ভালোবাসাটা এক একজনের কাছে এক একরকম। তাই তার প্রকাশভঙ্গীটাও ভিন্ন। এই ভিন্নতা কী বুঝতে পারা এবং সহজ সরল ভাষায়  ছোটো পরিসরে ব্যক্ত করতে পারাই গাল্পিকের সবচেয়ে বড়ো গুণ। এ গুণটা বেশ আলোকিতভাবে আছে জনাব মামুনে। অপরের হৃদয়কে পাঠ করার বিরল গুণ রয়েছে তাঁর। তাই অবলীলায় বলতে পারেন লীলাময় বিবরণ :

                       “কিছু অভিমান। কিছু কষ্ট। এর থেকে বেরিয়ে আসছে কেউ কেউ। কেউ বা বেরিয়ে এসে জয়ী                                  হয় অর্হনিশ। কেউবা হারায়ও। ঐ হারুয়াদের দলে নতুন নাম তুলেছি এই আমি। কারণ-আমি                                  হারতে জানি। হারতে শিখেছিলাম সেই কৈশোর বেলায়,আমার চিরদুঃখীনি মা'র কাছে। সেই                                   সময়  উদ্বেলিত হতাম হেরে যাওয়ার আনন্দে।”

সুভাষের লেখক সত্ত্বা জাগতিক সূত্রের এলেবেলে ঝিলে ভেসে ভেসে নেচে বেড়ানো উৎপল, তবে এই উৎপল কণ্টকাচ্ছাদিত। সাধারণত মানুষ প্রেমের পর লেখক হন, ভালোবাসার চড় লেখক হতে বাধ্য করে কিন্তু সুভাষ উল্টো। লেখক হওয়ার পরই তিনি ভালোবাসতে শিখেছেন। তার ভালোবাসা শুধ মানুষ নয়, কষ্টরাও তার ভালোবাসা পাত্র। কষ্টে কষ্টে তার চেতনা হয়েছে ঘাতসহ। এমন অভিজ্ঞতা তাঁকে করেছে আবেগহীন আবেগে ঋদ্ধ। অন্যদিকে আত্মবিশ্বাসী ও পরিসুদ্ধ। লেখার সময় আবেগকে টেনে ধরে নিজের ইচ্ছেমতো গল্পকে গল্পের লক্ষ্যে ধাবিত করার বিরল গুণ রয়েছে তাঁর। লেখক হওয়ার পর তিনি পুরোই লেখক, ভালোবাসায় পুরোটা ভালোবাসা এমন মজ্জাগত একাগ্রতা সুভাষের গল্পের স্বভাবগত মাধুর্য  : 

              “কোন নৈঃশব্দ রাতে স্তব্ধতার বুক চিরে
                বেরিয়ে আসে, এক অভিশপ্ত জীবনের গল্প।
              ঐ মুহুর্তে এক আনাড়ি লেখক দর্শক হয়। খুঁজে ফিরে
              জীবনের স্পন্দন ! [ সুভাষ সর্ব্ববিদ্যা]।

কয়জন লেখকে এমন বাঙময় চঞ্চলতা রয়েছে, রয়েছে এমন  বৈচিত্র্যময় তারল্য। যেভাবে চিন্তা করা যায়, যেভাবে
সুভাষ সর্ব্ববিদ্যা, শামসুদ্দিন শিশির, হায়াৎ মামুদ, ড. মোহাম্মদ আমীন
টানা যায় সেভাবে করা যায়। অনুভবের এমন বহুমুখীনতা  লেখার বিরল সৌন্দর্য। নবীন লেখক হলেও তার গল্পে অনেক পরিপক্কতার ছাপ, এটি বয়সের ছাপ নয়, দক্ষতার নিদর্শন। পড়তে পড়তে অন্য জগতে চলে যেতে হয়।  তাঁর গদ্যকে পৃথক করা যায় না কবিতা হতে। তবে পার্থক্য আছে। তাঁর গদ্যে পদ্যের গভীরতা আছে কিন্তু পদ্যের মতো জটিল নয়, পাঠক সহজে পড়ামাত্র বুঝে নিতে পারেন প্রতিটি অক্ষরের বিন্যাসের প্রতিবিন্যাস। তাঁর গল্প কবিতার মতো ছন্দোময় কিন্তু আবেশটা কবিতার চেয়ে ঢের কোমল এবং গানের চেয়ে অভিনব। কারণ এখানে অতৃপ্তির যে নেশা, তা নিটোল প্রেমিকের জোয়ারভাঙা বিরহের চেয়েও প্রবল। তাই সুভাষের গল্প কবিতার বিজয় কেতন, সুরের মোহনায় দর্শনের অনুভূতি এবং প্রেমের নিসপিস কম্পনে  জীবনের অভিধান। প্রকৃতিকেও তিনি তার প্রেম আর জীবন-জীবিকার প্রাপ্তি অপ্রাপ্তিতে ডেকে আনেন সাদরে :

              “সেদিন ছিল পোয়াতি জ্যোস্না
               কী এক অজানা আবেশে
               জড়িয়ে ধরলে তুমি, ঠাঁই নিলে 
              আমার বিদীর্ণ বুকে। 
             সেদিন  পোয়াতি জ্যোৎস্নাও স্বাক্ষী ছিল।” 
যতই কষ্ট থাকুক জীবনে, যতই অপ্রাপ্তি থাকুক দিবনদে, যতই হাহাকার থাকুক তমরার গলায়, তবু সুভাষ সুভাষিত তার জীবনবোধের নন্দিতে। তাই সব ছাপিয়ে উজাড় হয়ে ওঠে তার কণ্ঠ নবজাতকের মতো নবকোরকের স্বপ্নীল প্রাতে  প্রশ্নাতীত লাস্যে : 
               “তুমি আমার একটা দিনের দিবস নও মা। ৩৬৫টি দিনই এক একটি দিবস। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে                        যখন  ঘরে ফিরি। তোমার কষ্ট মাখা মুখে ফুটে উঠে এক চিলতে হাসি। আর ওই হাসিই আমার যাপিত                     জীবনের  এক  সমুদ্র সুখ। মুহুর্তে আমি ভুলে যাই আমার অতীত বর্তমান সবকিছু সবকিছু।”

শুধু গল্পে নয়, কবিতাতেও তার একই প্রার্থনা, একই সুর ধ্বনিত হয় সহাস্য কষ্টের আনন্দমাল্যে। যা দিয়ে কবি, তাঁর পাঠককে এটাই শেখাতে চাইছেন যে, জীবনের চেয়ে বড়ো উপহার আর হতে পারে না। জীবনের তুলনায় কষ্ট সমুদ্রের তুলনায় এক বিন্দু জলের চেয়েও নগণ্য। অতএব কেন, আমাদের আকুতি থাকবে, কেন থাকবে প্রাপ্তির কান্না। এ তো জীবনকে আরো কষ্টময় করে তুলবে। সুতরা অপ্রাপ্তি ভুলে প্রাপ্তি মগ্ন হবো প্রেমের শীৎকারে। ভালোবাসায় ফেলে সব কষ্ট আর অপ্রাপ্তিকে শেষ করে দেব।
“একেতো বিদ্যুতের ভেল্কিবাজি
তার 'পরে অসহ্য গরম
তবু ও কমতি নেই
ভাই -বোনের অটুট বন্ধন..।

No comments:

Post a Comment