Friday 22 December 2017

মেয়ে গৃহকর্মী ওসি এবং স্ত্রী রিভিউ / শ্রাবন্তনাহা অথৈ

মেয়ে গৃহকর্মী ওসি এবং স্ত্রী  ড. মোহাম্মদ আমীনের লেখা ভালোবাসা শুধুই ভালোবাসা গল্পগ্রন্থের একটি গল্প। গল্প কতো জীবন্ত, বাস্তব
এবং হৃদয়গ্রাহী হতে পারে তা এই গ্রন্থটি না পড়লে বোঝা যাবে না। সৌভাগ্যবশত আমি এই গল্পগ্রন্থের পাণ্ডুলিপিটা একবার পড়ার সুযোগ পেয়েছি। এজন্য প্রমিতার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। কোনো  লেখকের বই প্রকাশের আগে পাণ্ডুলিপি ছুঁয়ে দেখতে পারা এবং লেখকের কাছ থেকে পাওয়া পাণ্ডুলিপি পড়তে পারার বিরল অনুভূতির সঙ্গে যদি বইয়ের অসাধারণত্ব যুক্ত হয় তাহলে সেটি জীবনের অবিস্মরণীয় ঘটনা হয়ে ওঠে। আমি এমন অবিস্মরণীয় ঘটনার স্বাদ পেয়েছি।
ভালোবাসা শুধুই ভালোবা গল্পের প্রত্যেকটি গল্প ইতিহাসের মতো জীবন্ত। লেখকের জীবনের বাস্তব ঘটনা নিয়ে অনবদ্য সাহিত্যমগ্ন উপস্থাপনা পাঠকে শুধু আনন্দই দেবে না, লেখকের সঙ্গে একীভূত করে দেবে জীবনের চাওয়াপাওয়া, টানাপোড়েন আর হাসি-কান্নার আনন্দবিধুর সমাসন্নতায়। এমন বই আমি পড়িনি। এটি আমার কোনো বাহুল্যাক্তি নয়, অনুভবের নিবিড় অভিজ্ঞতা। মানুষকে মননশীল হতে হলে সাহিত্যকর্ম অধ্যয়ন কত আবশ্যক তা এই গ্রন্থটি পড়লে বুঝতে পারবেন।
বইটির প্রকাশক পুথিনিলয়, প্রচ্ছদ করেছেন মামুন হোসাইন, দাম ১২০ টাকা। বইটি আগামী অমর একুশে গ্রন্থমেলার (২০১৮) পুথিনিলয়ের স্টল থেকে সংগ্রহ করে নিতে পারেন। এখানে গল্পগ্রন্থটির একটি গল্প দেওয়া হলো। এটি লেখক তার ফেসবুকে প্রচার করেছেন। আশা করি ভালো লাগবে। আমি নিঃসন্দেহে বলতে পারি, এই বইটি আপনার সংগ্রহশালাকে সমৃদ্ধ করবে। আপনাকে করবে আনন্দ আর প্রত্যয়দৃষ্টে নির্ভরশীল ও সাহসী। তাহলে পড়ে দেখি গল্পটি :

মেয়ে গৃহকর্মী ওসি এবং স্ত্রী  রিভিউ


২০০১ খ্রিষ্টাব্দের কথা।
আমি তখন যশোর জেলার অভয়নগর উপজেলার ইউএনও।ইউএনও হিসেবে এটি আমর দ্বিতীয় পদায়ন। এর আগে ছিলাম শরীয়তপুর জেলার ভেদরগঞ্জের ইউএনও।
সৌজন্য সাক্ষাতে এসেছেন অভয়নগর থানায় সদস্য যোগ-দেওয়া ওসি। সঙ্গে সেকেন্ড অফিসার। পিয়ন মালেক তাদের ড্রয়িং রুমে
ড. মোহাম্মদ আমীন
বসতে দিলেন। আমি তখন দোতালায় ঘুমোচ্ছিলাম।
ওসি মানে অফিসার ইনচার্জ। মর্যাদায় পুলিশ পরিদর্শক।উপজেলার জবরদস্ত অফিসার। তাকে খাতির করেন না এমন অফিসার নেই। শুধু অফিসার কেন, রাজনীতিক নেতারাও খাতির করেন। উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে খাতির না-করলেও চলে কিন্তু ওসিকে খাতির না-করে উপায় নেই। যার লাঠি তার মাটি। লাঠির জন্ম হয়েছে মাটি দখলের জন্য।
ওসি সাহেব ড্রয়িং রুমে বসে আমার জন্য অপেক্ষা করছেন।বারান্দায় একজন মেয়ে হাঁটছে।ওসি সাহেব মেয়েটিকে বললেন : মা একটু এদিকে এস তো।
এগিয়ে আসে মেয়েটি : কিছু বলবেন?
: এক গ্লাস পানি দাও। 
মেয়েটির ইশারা পেয়ে পিয়ন মালেক এক গ্লাস পানি দিয়ে গেলেন। 
ওসি সাহেব, দারোগাকে বললেন : ইউএনও স্যারের মেয়েটি বেশ সুন্দর। 
আরও কিছুক্ষণ কেটে যায়।এখন মেয়েটি বারান্দায় কাপড় নাড়ছে। ঘড়ি দেখলেন ওসি সাহেব। অফিসে অনেক কাজ। তাড়াতাড়ি যেতে হবে।
মেয়েটিকে আবার ডাক দিলেন ওসি সাহেব : মা, তোমার আব্বুকে আমার খবর দিয়েছ?
মেয়েটি কিছু না বলে উপরে চলে যায়। ওসি সাহেবের আগমনবার্তা জানার কয়েক মিনিট পর নিচে নামলাম।
সালাম দিয়ে হ্যান্ডসেকের জন্য হাতি বাড়িয়ে দিলেন ওসি সাহেব। 
দুজন উপজেলার হর্তা-কর্তা।ওসির হাতে লাঠি, আমার হাতে তাজ। তবে লাঠির ক্ষমতা তাজের চেয়ে বেশি। দুজনের বনিবনা না হলে উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে অপদস্থ হতে হয়। তাজ দিয়ে কাউকে পেটানো যায় না। কিন্তু লাঠি দিয়ে তাজ কেন, মাথা পর্যন্ত ফাটিয়ে দেওয়া যায়। তাই সর্বত্র লাঠির জয়। 
হ্যান্ডস্যাকের পর শুরু হলো গল্প- চাকরি, দেশ, উপজেলা- - - সংসার
ওসি সাহেব বললেন : আপনার মেয়েটি কোন ক্লাশে পড়ে স্যার? 
: আমার মেয়ে স্কুলে পড়ে না। ছয় মাস বয়স। একমাত্র ছেলে ক্লাস ফোরে পড়ে।
: বারান্দায় একটা মেয়েকে দেখলাম, কাপড় নাড়ছে। সে কে?
আমি বললাম : গৃহকর্মী। শিশুবেলা থেকে আমাদে বাসায়। খুব ভালো মেয়ে।
একটু লজ্জা পেয়ে গেলেন জামাল সাহেব। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আবার স্বাভাবিক হয়ে যান। কাজের মেয়েকে নিজের মেয়ের মতো এমন সাজিয়ে গুছিয়ে রাখলে যে কেউ এমন ভুল করতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা, গৃহকর্মী কীভাবে এত সুন্দর হয়! অত চিন্তা করে লাভ নেই, বড় অফিসার, বড় কাজকারবার- ওসি সাহেব মনে মনে ভাবলেন। 
দারোগা ফিস ফিস করে বললেন : আজকাল অনেক বাসায় এমন দেখা যায়। এটা একটা ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কলিকালে আরও কত কী দেখা যাবে!
কিছুক্ষণ পর বারান্দার মেয়েটি ড্রয়িং রুমে ঢুকল। ওসি সাহেব মেয়েটিকে দেখে বললেন : স্যার, আমি কিন্তু এ মেয়েটিকে আপনার মেয়ে মনে করেছিলাম।তাকে দেখে কাজের মেয়ে মনে হয়নি। কাজের মেয়েকে নিজের মেয়ের মতো যত্নে রেখেছেন। খুব ভালো লাগল। 
কিছুক্ষণ চুপ থেকে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে ওসি সাহেব বললেন : এ মেয়ে তুই আমার জন্য আর এক গ্লাস জল নিয়ে আয়। খুব গরম পড়ছে। তেষ্ঠা পাচ্ছে বার বার। তাড়াতাড়ি আসবি।
মেয়েটি না শোনার ভান করে মালেককে পানি আনার ইশারা দিয়ে সোজা আমার গা ঘেঁষে বসে বলল: তুমি চা খাচ্ছো না কেন?
ওসি সাহেব মেয়েটির কাণ্ড দেখে অবাক। পনের-ষোলো বছরের একটা কাজের মেয়ের সাহস দেখে চোখ তার রীতিমতো ছানাবড়া। হায় হায়, এ কী! একজন উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সঙ্গে কাজের বুয়ার এমন ঢলাঢলি, তা-ও আবার ওসির সামনে, ছি! কী অনাচার!
চায়ের কাপ হাতে নিতে নিতে আমার পাশে বসা মেয়েটিকে দেখিয়ে বললাম : ওসি, সাহেব ইনি আমার স্ত্রী।
জামাল সাহেবে যেন আকাশ থেকে পড়লেন। লজ্জায় তার ফর্সা আর নাদুস-নুদুস পুলিশি চেহারাটা ফ্যাকাশে। জগ থেকে গ্লাসে গলগল করে পানি ঢেলে বললেন : কী বললেন স্যার?
: আমার স্ত্রী।
ওসি সাহেব অনেক কষ্টে ডান হাতটা কপালে তুলে আমার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন : আসসালামুআলাইকুম।
----------------------------------------------------
সূত্র : ড. মোহাম্মদ আমীন, ভালোবাসা শুধুই ভালোবাসা গল্পগ্রন্থের একটি গল্প।
প্রকাশক : পুথিনিলয়। প্রচ্ছদ : মামুন হোসাইন
প্রাপ্তিস্থান : পুথিনিলয় স্টল, অমর একুশে গ্রন্থমেলা/২০১৮।

No comments:

Post a Comment