Thursday 29 March 2018

মোহাম্মদ হোসাইন প্রকৃতির কবি পরিতৃপ্তির অনুভব / ড. মোহাম্মদ আমীন


মোহাম্মদ হোসাইন প্রকৃতির কবি, পরিতৃপ্তির অনুভবে প্রোজ্জ্বল। তিনি ভেতরে উদ্গম ভেতরে বৃষ্টিপাত আবার কখনোর
মোহাম্মদ হোসাইন
রূপ প্রকৃতির বিনম্র চিঠি।বিভাজিত মানুষের মুখ তাঁর অন্তিম যাদুর ঘূর্ণন।প্রকৃতির সঙ্গে একাকার কবি মোহাম্মদ হোসাইন  নৈঃশব্দের এস্রাজে সুর পান বৃষ্টির, বৃষ্টির গান মায়বাস্তবতার ফেনিল প্রেমের ধুসর দোসরে রমণীয় হয়ে ওঠে কাব্যভুক মানুষের মতো নিপাট অবলীলার শিশুমনসারল্যে।


 মোহাম্মদ হোসাইন কবি, না মানুষ? মানুষ, না কবি? আমি তাঁর পাঠানো সাতটি বই পড়ে কোনো সিদ্ধান্তই নিতে পারিনি। বরং যতবার সিদ্ধান্ত নিতে গেছি, ততবাই বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছি। কবিতায় এমন বিভ্রান্তি না থাকলে আমি বলতাম তিনি মানুষ। না তিনি আগে মানুষ হলেও আমার কাছে প্রথমত তিনি কবি। কারণ কবিতা দিয়ে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়। কবি না হলে হয়তো পরিচয় হতো না কখনো। তাঁর কবিতা বহুমুখী প্রকাশের অসংখ্যলাস্যের বিমুগ্ধপাতন।  কষ্ট বা উচ্ছ্বাসের আক্ষেপ নয়, মুগ্ধ মোড়কে মোড়া সাতটি কাব্য যেন সাতটি মহাসাগর।  একটিতে ডুব দিয়ে আর একটিতে পৌঁছার অদম্য ইচ্ছা কাব্যপ্রেমী
যে কারো মনকে নেশাতুর করে দিতে পারে। আমি শুরু করেছি ‘ভেতরে উদ্‌গম ভেতরে বৃষ্টিপাত’ দিয়ে। এই কাব্য দিয়ে শুরু করতে যাওয়ার কারণ কী এর উত্তর হচ্চে কোনো কারণ নেই, কোনো কারণ না থাকাই  সবচেয়ে বড়ো কারণ। কারণ থাকলে কারণ আর আসে না। প্রতিটা কাব্যই সাতটি মহিমা হয়ে এসেছে আমার কাছে। বুঝি না বুঝি পড়তে হবে। কিন্তু পড়তে গিয়ে দেখলাম মোহাম্মদ হোসাইনের কবিতা পড়া যায়, বোঝা যায় জানা যায়। এত সহজ নির্গমের মাঝেও চিন্তার দীপ্তি আলোকবর্ষকে ছড়িয়ে। আমি মনে করি, এখানেই হোসাইনের কবিতার আসল আকর্ষণ এবং বিরল সৌন্দর্য নিহিত। তার কবিতায় শব্দগুলি তার দিকে চেয়ে পাঠকের মনে অবিশ্রান্ত ভাবনা তুলে দিতে পারে। 

শুরুতেই জাল এবং পড়তে পড়তে সত্যি আটকে গেলাম কবিতায়। পুটি মাছ যেভাবে আটকে যায় জালে কিংবা মাছিরা মধুতে। কবির ভাবনার জালে পুটি মাছের মতো আটকে পড়া আছে কিন্তু মুক্তির তাড়না নেই। যতই আটকে যাচ্ছি মুক্তি যেন ততই বিকশিত হয়ে উঠছে। আহ! কবিতা পেলে বন্দিত্ব পরিসম্ভণময় হয়ে ওঠে। যেমন কবি মোহাম্মদ হোসাইনের ভাষায়-
“জাল ফেলি নদীতে
মাছ নয় জালগুলো হাঁস,
হাঁসগুলো চিত্রকল্প
পঙ্ক্তি মোড়ানো কবিতাসারস।” [ ভেতরে উদ্‌গম ভেতরে বৃষ্টিপাত]।

বৃষ্টির গান মায়াবাস্তবতা হোসাইনের রঙিন মন দিয়ে বিভূষিত রঙিন প্রচ্ছদের বিনোদ বরণ যেন।
মুগ্ধকর শব্দবিন্যাস। বিন্যাসের আড়ালে অপ্রাপ্তির ঝরণায় প্রাপ্তির পোখরাজ এই হলো শব্দ এই হলো উপমা, এই হলো প্রীতি, হোসাইনের কবিতার প্রীয়মাণ পোষিত আত্মাহুতি। তিনি মৃত্তিকার সন্তান, পতাকায় আটকে রাখে বুক ভালোবাসার অহর্নিশ যাতনায় এবং অভিসারের মধুর প্রতীক্ষায় মাটিতে গন্ধসুখে প্রিয়তমার ঘামের। মায়ের ছবি আঁকেন মৃত্তিকার সোঁদা গন্ধে ভালোবাসার নীলিমায় বুকে ধরে রাখার জন্য। কবিতায় তার প্রেমে প্রেমে শপথ হয়ে ওঠে দেশপ্রেম। তাই ঘুমের ভেতরে জেগে ওঠে নদী। প্রকৃতির অলিগলি ছুটে আসে তার কবিতার বনন্দিত ভাবনায়। কবির মন প্রাণ থেকে প্রাণে আলুলায়িত রমণীর আকণ্ঠ প্রহর হয়ে ওঠে জারুল গাছের সবুজের বগলে বগলে ছুটে চলা প্রজাপ্রতির মতো। অতীত আর ভবিষ্যতের সেতু বাঁধেন কবি, হতাশায় মাঝে মাঝে শব্দেরাও হেসে ওঠে-

“তবু শরৎ আসে, ফিরে ফিরে আসে সেই কাশফুল,
সেই নদী তীর, আর
অজান্তেই ভেসে ওঠে সেই মুখ
দিনমান যে বুকের ভেতর ডুকরে ডুকরে কাঁদে। [ সেই মুখ, বৃষ্টির গান মায়াবাস্তবতা]
পৃথিবীতে প্রতিদিন রাত নামে ঠিকই
সবার জীবনে নিয়ম করে
রোদ কেন নামে না যে... ” [ ভেতরে উদ্‌গম ভেতরে বৃষ্টিপাত]

তিনি জানেন রোদ কেন নামে না। এটি কথার কথা। এই যেমন আমরা বলি, বাঁচতে আর সাধ নেই। এর মানে আসলে মরে যাওয়ার ইচ্ছে নয়, বরং বাঁচার সৌন্দর্যকে আরো প্রবল মমতায় অনুভব করা।
তাঁর কাব্যসপ্তকের কবিতামালার প্রত্যেকটি লাইন ছন্দপ্রকৃতির বিমল সৌন্দর্যের নিটোল ললাট হয়ে আমার আগ্রহকে কখনো রাত কখনো সন্ধ্যা আবার কখনো বা ভোর-দুপুর কিংবা রূপোলি বিকেল করে অনন্ত আঁধার থেকে বিশাল
আধারে নিয়ে গিয়েছিল। কখনো রাগ, কখনো ক্ষোভে, কখনো হাসি আবার কখনো নির্মোক- সাপ উধাও। এই না হলে আবার কবিতা! আমার কাছে কবিতা প্রকৃতির মতো অভিমানী নারীর সুন্দর বায়না, বজ্জাত রাগের মতো ফুঁসে ওঠা অভিমান। প্রকৃতির সঙ্গে কবির প্রেমের স্বপ্নসূত্রের পানশালা ঢেকে দিয়েছে অনিন্দ্য চেনা কেউ। যাকে বার বার শুধু পেতে চাই মন, ছাড়তে চায় না একটুও। ভালোবাসায় তাকে বেঁধে ফেলেছে কবি, বিনিদ্র সাহসিকায়। তাই বলতে পারেন অবলীলায়, “ চাইলেই যাওয়া যায় না। অন্তিম যাদুর ঘূর্ণনে ব্যতিব্যস্ত থাকতে হয়, ব্যতিব্যস্ত রেখে দেয় কবি হোসাইন, না না, ভুল বলেছি, কবি হোসাইনের কবিতা। কবিকে কে চেনে,  মরে যাক কবি, তাতে পাঠকের কিছু যায় আসে না, তাদের কাছে কবিতাই মুখ্য। হোসেনও এমন মনে করেন। তাই তিনি নিজেকে ঢেলে দিয়েছেন কবিতায়।  এভাবে বেঁচে থাকতে চান কবিতায়-

“স্নেহশীলা জল, গড়ানো প্রপাতের মতো, হিমকণা বাষ্পের মতো বেদনা
হয়ে রয়। অথচ নমিত আকাশ যেমন, তেমনই নীল ছোপ চিরায়ত 
বর্ণের আকার! কে জানে, আমারও প্রতিভাও, একদিন এমনই ছিল
দিকশূন্যহীন, অর্বাচীন! আজ তাই বারেবারে মানুষের কাছেই ফিরে ফিরে 
আসি - -।” [ মানুষের কাছে. অন্তিম যাদুর ঘূর্ণন]।

কবির কবিতায় প্রকৃতি আছে প্রেম হয়ে। পঙ্ক্তিতে বাক্যগুলি নিবিড় ভালোবাসায় রঞ্জিত। অনুভবের অনুভাবনাগুললো  অনুত্তাপ উষ্ণতার শিখা হয়ে পাঠকে আকড়ে থাকে, পাঠককে আকড়ে রাখে যেন বই নয়, কবিতা নয়;  খুব কাছ থেকে প্রকৃতিকে নিবিড় মমতায় উপভোগ করা।  প্রেমিকার বিশুদ্ধ কপোলে সমুগ্ধ চুম্বন লেফটে দেওয়ার মতো অবাধ্যে 
 “-- সন্ধ্যের আকাশ আর আমি নিরিবিল কথা বুনে যাই, সেলাই করা হাওয়া
কতবার যে বুকে এসে পড়ে, কতবার সে সঘন চুমু খায়।” [ সঘন হাওয়া, বিভাজিত মানুষের মুখ]।

 কোন কাব্যটি ভালো লেগেছে? আমার  ছেলের এই প্রশ্নের উত্তরে একটি কাব্য তুলে দেওয়ার মতো বুদ্ধি
আমার জাগল না, সব কাব্য পড়ার পরও। কেন? আমাকে আমি প্রশ্ন করলাম। উত্তর এল, তাও কাব্যময়। কবিতা আসলে আমি বুঝি না। তাই সবসময় এটি আমার কাছে নারীর মতো রহস্যময় মনে হয়। হোসাইনের কবিতা অনুপম মহিম এবং নিরূপম মগ্নতার সৌধ। যেন উচ্চৈঃস্বরের ব্রহ্মফটকে উদীর্ণ উদ্বেল মহাসাগরের ঢেউয়ে ঢেউয়ে ফেনিল প্রশান্তিতে অসীম করে দিতে চয়িত হয়েছে সসীমকেএখনে কবি হোসাইন তাঁর উন্মীলিত জীবনের চাওয়া-নাপাওয়া বিষয়গুলিকে অবহেলা করে ভাবনার অন্তরালে সঁপে দিয়েছেন নিজেকে। তাই কোনো দুঃখ তাকে অবনমিত করতে পারে না। যতই নৈঃশব্দ্য বলা হোক না কেন, হোসাইনের প্রতিটি কবিতায় শব্দনিপুণ এস্রাজ। তিনি কবিতার মতো এগিয়ে চলেন সর্বজীবের কল্যাণে।  কবির ভাষায় -
“আজন্ম লালিত স্বপ্নগুলো বুক থেকে বুকে চোখ থেকে চোখে
অবিরল ছড়িয়ে দেবো মিহিদানা করে রৌদ্রের পাখনায়।” [ নৈঃশব্দ্যের ইন্দ্রজাল, নৈঃশব্দ্যের এস্রাজ]

কবি হোসাইনের আর একটি বিরল প্রতিভা পদ্যয়ন। তার কলম বাক্য পেলে  শব্দগুলিকে কবিতার সজ্জায় সজ্জিত করে দেয় বিকশিত নারীর উপাত্যাকার মতো।  কী অবলীলায় তিনি গদ্যকে কবিতার চেয়ে উষ্ণ
করে দিয়েছেন প্রিয়তমার ওমের মতো বিরল গন্ধে। এখানে কবি বর্তমান সমাজের বাস্তবতা, মানুষের পার্থিব লোভ, আর্থিক গ্রাসতাকে ভালোবাসার কাছে কীভাবে বলি হতে হয় আবার কীভাবে অর্থ মৃত ভালোবাসাকেও জীবন দেয়, তা খুব করুণ কিন্তু মাধুর্যমণ্ডিত বাক্যে তুলে ধরেছেন। কবির ভাষায়-

“তোমার বাবা মাকে বলবো আমি সেই বেকুব কবি, যাকে একদিন দূর 
দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন গেটের বাইরে থেকে ‘আমি সেই’। সেদিন
 কিন্তু তুমি আমাকে ইগ্নের করতে পারবে না, সুতুপা। আর তোমার 
বাবা-মাও নিশ্চয় আমার মত অমন উদীয়মান, সম্ভাবনাময়, পাওয়ারফুর রাজনীতিককে হাতছাড়া করতে চাইবেন না, কী বলো?”[একটি কবিতার খসড়া,  নৈঃশব্দ্যের এস্রাজ]

কবির মতো জীবন এক অবিদিত শূন্যের ঘের। যেখানে চারদিক অজানা রহস্যের নৃশংস পঙ্কিলতা, তবু জেগে ওঠে কোমল কমল।কবির ভাষায়, “বিকেলের নিভে যাওয়া আলো অবিমিশ্র জীবন সংবেদ।” এটাই প্রকৃতি, এটাই প্রেম। এখানে জেগে থাকে জীবনের আজীবন প্রতীতি। সিলেটের সবুজ প্রকৃতির মতো রঙিন মনে তার লালচে মৃত্তিকার অবয়ব যেন সব মানুষকে ভালোবাসায় ভালোবাসায় একাকার করে দিতে এসেছে। কবি তাই বলে ওঠেন -

“চা পাতার দেশে এ যেন আরেক সুন্দরবন
চারপাশে সার সার কী হিজল, তমাল
অর্নের, কদমের কী মায়াময় নাম।” [সোয়াম্প ফরেস্ট, রাতারগুল. রূপ প্রকৃতির বিনম্র চিঠি]।

মোহাম্মদ হোসাইন কবি, এটাই আমার সঙ্গে তার  যোগসূত্র। রবীন্দ্রনাথকে যেমন আমি দেখিনি, তাঁকেও তেমন দেখিনি। তবে তিনি এখনও শরীর ধারন করে আছেন, রবীন্দ্রনাথ নেই এটাই ভৌত পার্থক্য।
তিনি আমার কাছে সাতটি কাব্য পাঠিয়েছেন। তার কাব্যগুলো পড়ে আমি কতটুকু বুঝতে পেরিছি জানি না। শুধু মনে হচ্ছিল আমার বুঝতে ভুল হচ্ছে কোথাও, কিন্তু শেষে যখন তার কাব্য ‘ভুল হচ্ছে কোথাও ভুল হচ্ছে’ পড়লাম, তখন মনে হলো- ভুল নয় ফুল। ভুল আছে বলেই জীবন এত সুন্দর। কবি তাই ভুল হচ্ছে জেনেও ভুলের জায়গা খুঁজেন না, ভুল করে যান ফুলের আসায়। কিছু কিছু বানান ভুল ছাড়া হোসাইনের কাব্যে তেমন কোনো ত্রুটি চোখে পড়েনি। তার লেখা ‘ভুল হচ্ছে কোথাও ভুল হচ্ছে’ কাব্যের কয়েকটি কবিতার পড়ার পর আমার লেখা ছোটো দুটি লাইন মনে পড়ে গেলে-
“ভুল থেকে ফুল, ফুল থেকে বৃক্ষ
                          তাতেই জীবন সবুজ, মহিম অন্তরীক্ষ।”[ ড. মেহাম্মদ আমীন, নির্মৎসরী]

আমি পড়লাম কবি মোহাম্মদ হোসাইনকে, পড়লাম তার কবিতা, দেখলাম শব্দসজ্জার বিচক্ষণ কৌশল। সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে ভিন্ন দ্যোতনায় লেখা কবি মোহাম্মদ হোসাইনের কাব্য ‘ভুল হচ্ছে কোথাও ভুল হচ্ছে’ পড়ার পর আমাকে তৃপ্তির অবশ আলো ঘিরে ধরল।হোসাইনের সহজ সরল প্রকাশের মাঝে মুগ্ধ দর্শনের দৈবিক চাঞ্চল্য আমাকে আবার সরস করে দিল জীবনের কলহাস্যে। কবি মোহাম্মদ হোসাইনের ভাষায়, 
“একদিন সূর্যকণার সাথে সে নাম মিশে রবে, ঘাসে ঘাসে
বিস্ফোরিত হবে নিটোল অভ্রকণা, মর্মকথা বীজাণুর--”[নষ্ট দোতারা, ‘ভুল হচ্ছে কোথাও ভুল হচ্ছে’ ]

(খসড়া)

2 comments:

  1. কীভাবে যে আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করব--জানিনা। আপনি আমার মত একজন অদেখা, অচেনা মানুষের কবিতা পড়ে যে অনুভূতিমালা উপহার দিয়েছেন সত্যি আমার জন্য তা পরম প্রাপ্তি। এ স্বল্প পরিসরে হয়ত সবকিছু বলাও সম্ভব নয়, তবুও আপনাকে আমার সশ্রদ্ধ সালাম, ভালোবাসা ও নিরন্তর কৃতজ্ঞতা।

    ReplyDelete
  2. একগুচ্ছ ভালোলাগা রেখে গেলাম।

    ReplyDelete