Thursday 25 January 2018

স্যমন্তক ও হায়াৎ মামুদ


উপন্যাস নির্মল আনন্দের উৎস। তাই সাহিত্যজগতে উপন্যাস সবচেয়ে জনপ্রিয়। কোনো কোনো উপন্যাস পাঠকের মনে গভীর দাগ
কাটে। উপন্যাসের অচেনা-অজানা চরিত্রসমূহে মনপ্রাণ একাকার হয়ে যায়। গভীর নিবেশে আবেশিত হয়ে ওঠে হৃদয়। ব্যক্তিগতভাবে অচেনা চরিত্রগুলোও ভাবনায় শিহরণ তোলে। যদি আপনি এমন একটা উপন্যাস পড়েন, যার প্রায় সবকটি চরিত্র আপনার পরিচিত, শ্রদ্ধার্হ, খ্যাতিমান প্রিয়- তাহলে কেমন লাগবে? কেমন শিহরিত আনন্দে কেঁপে উঠবে অনুভূতি? ভাষায় এটি প্রকাশ করা যায় না। তবে, স্যমন্তক উপন্যাস পড়লে এমন বিরল অনুভূতির পুরোটাই আস্বাদন করতে পারবেন পরিচিত চরিত্রসমূহের বুদ্ধিদীপ্ত সংলাপস্যমন্তকউপন্যাসের অন্যতম আকর্ষণ। প্রতিটি লাইনই মুখস্থ করে রাখার মতো। অন্তত এজন্য হলেও . মোহাম্মদ আমনের স্যমন্তক উপন্যসটি পড়ে দেখতে পারেন।


স্যমন্তক কোনো সাধারণ উপন্যাস নয়। বাস্তবতার নিরিখে রচিত উপন্যাসের শৈল্পিক বিবরণ বস্তি হতে রাজপ্রসাদ পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রেসিডেন্ট, মন্ত্রিপরিষদ সচিব এবং নব্বইয়ের দশকে বাংলা সাহিত্যের উদীয়মান অধিকাংশ সাহিত্যিক, শিক্ষক, প্রশাসক বুদ্ধিজীবী স্যমন্তকের চরিত্র। উদাহরণস্বরূপ কবীর চৌধুরী, হাসনাত আবদুল হাই, হুমায়ুন আযাদ, জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, আলাউদ্দিন আল আযাদ, ইতিহাসবেত্তা আবদুল হক, মনিরুজ্জামান, আনিসুজ্জামান, হায়াৎ মামুদ, অরুণাভ সরকার, শিল্পী এস এম সুলতান, নরেন বিশ্বাস, দেলোয়ার হোসেন, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, মমতাজ উদ্দিন আহমেদ, আহমদ ছফা প্রমূখের নাম উল্লেখ করা যায়। আমার একজন ছাত্রী স্যমন্তকের নায়িকা। বস্তিতে বেড়ে ওঠা মেয়েটা এখন অক্সফোর্ডের অধ্যাপক। বস্তি থেকে অক্সফোর্ড- কীভাবে সম্ভব হলো? বস্তুত এর অনাস্বাদিতপূর্ব বিবরণই স্যমন্তক।

স্যমন্তক কী ধরণের উপন্যাস? নানামুনির নানা মত। কেউ বলেন, মনস্তত্বমূলক উপন্যাস। কেউ বলেছেন, আত্মজীবনীমূলক স্মৃতিচারণ। কারও কাছে এটি চেতনাপ্রবাহমূলক উপন্যাস। এক ঔপন্যাসিক বলেছেন, এটি কাব্যধর্মীমূলক প্রেমকাহিনি, একজন
বলেছেন সামাজিক উপন্যাস। কয়েকজন এটাকে আর্থ-সমাজিক প্রেক্ষাপটে বিধৃত ঐতিহাসিক উপন্যাস হিসাবেও মন্তব্য করেছেন। বিখ্যাত একজন সমালোচকের ভাষায়, এটি উদ্দেশ্যমূলক কাহিনি উপন্যাস। লেখকের মতে, জৈবন্তিক উপন্যাস। আমার মতে, এটি এখানে বর্ণিত সবধরণের উপন্যাসের সমন্বয়ে গঠিত একটি ব্যাষ্টিক উপন্যাস। যেখানে সকল প্রকার উপন্যাসের স্বাদ একসঙ্গে পাওয়া যায়। যেন একের ভেতর অনন্ত। যেদিক দিয়ে বিবেচনা করা হোক না কেন, সব উপাদান দেখা যায় স্যমন্তকে। জৈবিক বা সামাজিক বন্ধন ছাড়াও কীভাবে মানুষ রক্ত সম্পর্কের চেয়েও আপনজন হয়ে যায়, তার একটি চমৎকার দলিল স্যমন্তক।

স্যমন্তক উপন্যাসের বুদ্ধিদীপ্ত সংলাপ আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। প্রতিটি লাইনই মুখস্থ করে রাখার মতো। ভালোবাসা- দ্রোহ, স্নেহ-প্রেম, স্বার্থিক দ্বন্দ্ব, মায়া-মমতা-অভিমান, আর্থ-সামাজিক অবস্থা, পিতাপুত্র-পরিবার, ধর্ম, রাজনীতি, ইতিহাস, নগরজীবন, গ্রামীণজীবন, মূল্যবোধ, শিক্ষাব্যবস্থা, যোগাযোগ,
স্যমন্তক পড়ছেন হায়াৎ মামুদ
প্রশাসন, অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ, বিশ্বপ্রকৃতি এমনকি বস্তি হতে শুরু করে মনুষ্য জীবনের সঙ্গে জড়িত সবকটি বিষয় নিখুঁত মাধুর্যে বিধৃত হয়েছে।


উপন্যাসের চরিত্রসমূহ অধিকাংশ পাঠকের কাছে পরিচিত। তাই লেখককে প্রতিটি সংলাপ খুব সাবধানে লিখতে হয়েছে ঋদ্ধ সংলাপের সঙ্গে পরিশীলিত রসবোধ, উত্তম উদ্দেশ্য, ভাবনার প্রসারতা মানবতার স্ফূরণ উপন্যসটিকে অনবদ্য করে তুলেছে। জীবন থেকে নেওয়া ঘটনায় বিন্যস্ত এমন হৃদয়গ্রাহী পরিপূর্ণ উপন্যাস ইতোঃপূর্বে আমি পড়িনি। উদ্দেশ্য, কাহিনি, চরিত্র, বিষয়-বর্ণন, বুদ্ধিদীপ্ত সংলাপ, কাব্যিকতা, পরিশুদ্ধ জীবনবোধ, স্পর্শকাতর সম্পর্ক, মানবতার উৎকৃষ্ট নিদর্শন পরিণতি বিবেচনায় বাংলা সাহিত্যে এমন আর কোনো উপন্যাস আছে বলে আমার জানা নেই। এটি হতে পারে বাংলা সাহিত্যের একটি শ্রেষ্ঠ উপন্যাস

No comments:

Post a Comment